‘চার্লি সেভেন ফর বেজ, হাউ ডু ইউ হেয়ার মি? ওভার।’
‘বেজ ফর চার্লি সেভেন, ইউ আর লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার, সেন্ড ইয়োর মেসেজ, ওভার।’
‘চার্লি সেভেন ফর বেজ, অ্যাবাউট থার্টি সেভেন ট্রাকস লোডেড উইথ পাকিস্তানি আর্মি আর প্রসিডিং টুওয়ার্ডস ঢাকা সিটি ফ্রম দ্য ক্যান্টনমেন্ট।’
এটাই ছিল ২৫ মার্চ রাত ১০টা ৩০ মিনিটে তেজগাঁও এলাকায় টহলে থাকা পুলিশের ওয়্যারলেস অপারেটর আমিরুল এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের ওয়্যারলেস বেস স্টেশনের মধ্যে কথোপকথন।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যে অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয়, যা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক শুদ্ধিকরণ বা পলিটিক্যাল পার্জিং ও আদর্শগত পরিচ্ছন্নতা বা আইডিওলজিক্যাল ক্লিনজিং অপারেশন ছিল। অপারেশন সার্চলাইটের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল ২৬ মার্চ এর মধ্যে সামরিক বাহিনী কতৃক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনের দখল নেয়া, এবং বাছাই করে রাজনৈতিক কর্মী বা তাদের সমর্থকদের হত্যা করে পূর্ব পাকিস্তানকে পার্জিং বা শুদ্ধিকরণ করা। এটা করার জন্য তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাঙালী সংস্কৃতির সমর্থকদের সাংস্কৃতিক নির্মূলীকরণ বা কালচারাল ক্লিনজিং করা শুরু করে যেটা তাদের ধারণা মতে এক মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবার কথা ছিল। কিন্তু তারা ভাবতে পারেনি যে তাদের কর্মকান্ডের প্রতিক্রিয়ায় পুরো দেশ তাদের বিরুদ্ধে চলে যাবে এবং পরিণতিতে পাকিস্তানের অর্ধেককে হারাতে হবে।
পূর্ব পাকিস্তানকে পার্জিং বা রাজনৈতিকভাবে শুদ্ধিকরণ করা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাঙালী সংস্কৃতির সমর্থকদের সাংস্কৃতিক নির্মূলীকরণ বা কালচারাল ক্লিনজিং করার পরিকল্পনা কেবল ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং তার পরবর্তী সিদ্ধান্ত কখনই নয়। এটা পাকিস্তান রাষ্ট্র ধারণার নীল নকশার মৌলিক দর্শন যেখানে পাকিস্তান মানেই ভারতীয় মাটি ও সংস্কৃতির বিপরীত বা প্রতি-আদর্শ।
পাকিস্তানের জন্মের শুরুতে ১৯৪৭ সালের মে মাসে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অন্যতম প্রধান নেতা এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রথম প্রেসিডেন্ট চৌধুরী খলীকুজ্জমান ও জুলাই মাসে ভারতের আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব প্রদান করেন। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে করাচিতে এক শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী মাসে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের দাবি জানান। তার দাবি অগ্রাহ্য হয়। ফলে ২৬শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ১৯৪৮ সালের ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয় এবং বাংলা ভাষা দাবি দিবস ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯৪৮ সালের ৪ই জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্রলীগ এই কর্মসূচি পালনে বিশিষ্ট ভুমিকা পালন করে। ধর্মঘট পালনের কারণে শেখ মুজিব, শামসুল হক, অলি আহাদসহ ৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করলে ঢাকায় ১৩ই মার্চ থেকে ১৫ই মার্চ ধর্মঘট পালিত হয়।
এর পর পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১৯শে মার্চ ঢাকায় আসেন। ২১শে মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনি ঘোষণা দেন "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা।" এরপর ২৪শে মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ঘোষণা দিলে ছাত্ররা তার উক্তির চরম প্রতিবাদ জানায়। বিষয়টি এর পর কিছুটা স্তিমিত থাকে।
এর পর ১৯৫২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ২৫ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন এবং ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের এক জনসভায় দীর্ঘ ভাষণ দেন। তিনি মূলত জিন্নাহ্'র কথারই পুনরুক্তি করে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচারিত তার ভাষণে তিনি আরো উল্লেখ করেন যে কোনো জাতি দু'টি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারেনি। এর পর থেকেই “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” আন্দোলন জোরদার হয় এবং ক্রমেই সেটা বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ লাভ করে।
কেন রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ লাভ করল? আপনি যদি সিআইএর পার্জিং বা শুদ্ধিকরণ এবং জাতিগত বিলোপ বা এথনিং ক্লিনজিং সম্পর্কিত গোপন নির্দেশিকা ও নথিপত্রগুলো দেখেন, আপনি দেখবেন সেখানে ভাষা নীতিকে শুদ্ধিকরণ বা জাতিগত নির্মূলের একটি গুরুতর অস্ত্র হিসাবে নিবন্ধিত করা হয়েছে।
২০২২ সালে আমরা যে ইউক্রেন যুদ্ধের সূচনা দেখেছি, সেটা আসলে শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালেই ইউক্রেনে বসবাসকারী রুশ ভাষায় কথা বলা মানুষদের মাতৃভাষাকে অস্বীকারের মাধ্যমে। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে মার্কিন রঙিন বিপ্লবের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের পর, নতুন প্রশাসন রুশ ভাষার ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আনে। নতুন সরকার ২০১২ সালের ভাষা আইনটি বাতিলের চেষ্টা করে, যা রুশ ভাষাভাষী সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তবে, এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি এবং আইনটি কার্যকর থাকে। ২০১২ সালে ইউক্রেনের পার্লামেন্ট একটি আইন পাস করেছিল, যা রুশ ভাষাকে আঞ্চলিক ভাষার মর্যাদা দেয়। এই আইনের ফলে রুশ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা, প্রশাসন এবং অন্যান্য সরকারি কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ পায়।
কিন্তু সিআইএ নিয়ন্ত্রিত এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পরামর্শে ২০১৯ সালে ইউক্রেন একটি নতুন রাষ্ট্রভাষা আইন পাস করে, যা ইউক্রেনীয় ভাষার ব্যবহারের ওপর জোর দেয়। এই আইনের মাধ্যমে সরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য পাবলিক সেক্টরে ইউক্রেনীয় ভাষার বাধ্যতামূলক ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়। যদিও এই আইনটি রুশ ভাষার সরাসরি নিষেধাজ্ঞা নয়, তবে এটি রুশ ভাষার ব্যবহারের সুযোগ সীমিত করে।
সেই থেকেই কিছু শহর ও অঞ্চলে রুশ ভাষার ব্যবহারের ওপর অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা শুরু হয়। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিম ইউক্রেনের ইভানো-ফ্রাঙ্কিভস্ক শহরের মেয়র রুশ ভাষার ব্যবহারের ওপর নজরদারি করার জন্য "ভাষা পরিদর্শক" নিয়োগের ঘোষণা দেন। এই পরিদর্শকরা রুশ ভাষা ব্যবহারের ঘটনা রিপোর্ট করবেন এবং শহরে ইউক্রেনীয় ভাষার প্রচলন বাড়ানোর প্রচেষ্টা করবেন। ইউক্রেনে রুশ ভাষার ব্যবহারের ওপর আরোপিত আইন ও বিধিনিষেধগুলি দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন, জাতীয় পরিচয় এবং সামাজিক সংহতি বিনষ্টের সাথে সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। ২০১৯ সালে পাস হওয়া ইউক্রেনের রাষ্ট্রভাষা আইন, যা ইউক্রেনীয় ভাষাকে একমাত্র সরকারী ভাষায় পরিণত করে। এই আইন জনজীবনে ইউক্রেনীয় ভাষা প্রাত্যাহিক ব্যবহার, সরকারি কর্মী এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবহার থেকে শুরু করে জাতীয় টেলিভিশন এবং রেডিও সম্প্রচারের ৯০% কোটা পর্যন্ত নির্ধারণ করে। নাগরিকদের ইউক্রেনীয় ভাষা জানা বাধ্যতামূলক এবং বিনামূল্যে ক্লাসের সুযোগ ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা হয়। ডাক্তার এবং গ্রাহক পরিষেবার সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও ডিফল্টভাবে ইউক্রেনীয় ভাষা ব্যবহার করার ধারা সংযুক্ত হয়। চূড়ান্ত সংস্করণে ভাষা আইন অমান্যের জন্য শাস্তি হিসেবে জরিমানার বিধান রাখা হয়।
২০২২ সালের জানুয়ারীতে, ইউক্রেন ভাষা আইনের ২৫ অনুচ্ছেদে একটি নতুন বিধান যুক্ত করে। এতে ইউক্রেনের সমস্ত মুদ্রিত মিডিয়া আউটলেটকে হয় ইউক্রেনীয় ভাষায় প্রকাশ করতে অথবা ইউক্রেনীয় অনুবাদ প্রদান করতে বাধ্য করার বিধান যুক্ত হয়। সংবাদপত্রের দোকানগুলিকে তাদের কমপক্ষে অর্ধেক পত্রিকা ইউক্রেনীয় ভাষায় রাখতে বাধ্য করা হয়েছে। এই বিধানে ক্রিমিয়ান তাতার এবং অন্য আদিবাসী ভাষাগুলির জন্য ব্যতিক্রম রয়েছে, তবে উল্লেখযোগ্যভাবে, রাশিয়ান ভাষার জন্য সেটা নেই।
ইউক্রেন-রাশিয়া এবং বাংলাদেশ-ভারত এই দুই ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে অনেকগুলো গভীর মিল রয়েছে। যেমন উভয় ক্ষেত্রেই একটি পরাশক্তি পাশে একটি দরিদ্র এবং ভঙ্গুর রাষ্ট্রের বিশাল রাজনৈতিক সীমানা রয়েছে যে ছোট দেশগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি রয়েছে। ইউক্রেন ও বাংলাদেশ এই দুই দেশেই পাশের পরাশক্তির সাথে একই ভাষা ও সংস্কৃতির শেয়ারড বা ভাগাভাগি করা জনগোষ্ঠী রয়েছে যারা ভাষা ও অবিচ্ছিন্ন। ইউক্রেন ও বাংলাদেশ এই দুই দেশকেই যদি অন্য কোন পরাশক্তি যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোর মত সমর সংঘের আজ্ঞাবহ বা দালাল রাষ্ট্র হিসাবে ব্যবহার করতে হয় তাহলে উক্ত ভাষা-সংস্কৃতি প্রধান অন্তরায়। যে কারণেই আমরা দেখছি সিআইএ এবং ইউরোপের গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালিত ইউক্রেনের সরকার পরিবর্তন করে যে শুদ্ধিকরণ, সেখানে রাশিয়ান ভাষাভাষীদের সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদ নির্মূলের জন্য ভাষাকে করা হয়েছে প্রাথমিক অস্ত্র।
এই কারণেই ১৯৪৭ থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের শুদ্ধিকরণ ও বাঙালী জাতিসত্তাকে সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদ নির্মূলের মাধ্যমে বিলোপ করা পাকিস্তান শুরুর পরিকল্পনাতেই ছিল। সেই পরিকল্পনাতেই রাষ্ট্রভাষা উর্দু একটি শুদ্ধিকরণ বা জাতিগত নির্মূলের সামরিক মনোবিদ্যাগত অস্ত্র বা সাইঅপস অস্ত্র হিসাবে এসেছে, যেটি কখনই কিছু ব্যক্তির খেয়াল-খুশি ছিল না। তবে এই অস্ত্র কাজ করে সংস্কৃতির শিকড় কতটুকু প্রেথিত ও কতটা বিস্তৃত তার উপর। যদি টার্গেট গ্রুপের সংস্কৃতির শিকড় গভীরে প্রেথিত থাকে এবং সেটা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত থাকে তাহলে ফল বিপরীত হয়।
কিন্তু কোন স্থানে সংস্কৃতির শিকড় কতটুকু প্রেথিত ও কতটা বিস্তৃত সেটা বিদেশী শক্তির এজেন্ট বা থিংকট্যাংকদের পক্ষে পরিমাপ করা সম্ভব হয় না। সম্ভব হয় না বা মানুষ হত্যায় প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনীর পক্ষেও। সম্ভব হয় না জনবিচ্ছিন্ন ঠাট দেখানো দাপট দেখানো এলিট শ্রেণীর নার্সিসিজমে ভোগা রাজনীতিবিদদের পক্ষেও। সম্ভব হয় না ব্যক্তিগত বিচার বিবেচনা শিকায় তুলে রাখা ধর্মীয় নেতাদের পক্ষেও। সম্ভব হয় না সারা জীবন জ্বী হুজুর মানসিকতায় আমলাগীরি করেন তাদের পক্ষেও। সম্ভব হয় না সারা জীবন বই মুখস্ত করা কেতাবি পন্ডিত প্রফেসরদের পক্ষেও। এর ফলে ঘটে মহা বিপর্যয়।
যার ফলে সাইঅপসের রাষ্ট্রভাষা অস্ত্র প্রয়োগ করতে গিয়ে মার্কিন ডিপ স্টেটের গোলাম পাকিস্তানকে হারাতে হয়েছে তার অর্ধেক রাষ্ট্র, নিহত হয়েছে ত্রিশ লক্ষ মানুষ। ওদিকে একই অস্ত্র প্রয়োগকারী মার্কিন ডিপ স্টেটের নয়া গোলাম ইউক্রেনকে হারাতে হবে তাদের দেশের বড় অংশ। সেখানে নিহত হয়েছে ১৫ লক্ষ মানুষ। ভূমির প্রতিশোধ আর ভাষার প্রতিশোধ বড় প্রতিশোধ। ত্রিশ লক্ষ মানুষ হত্যার পর যারা বাংলাদেশ থেকে উর্দু ভাষায় বেতার সম্প্রচার করতে চেয়েছে, পাকিস্তানের সংস্কৃতিকে বাংলাদেশে আনতে চাইছে তাদের জন্য কি পরিণতি অপেক্ষা করছে? ভাষার অভিশাপ কিন্তু বড় অভিশাপ।
©2025 Sirajul Hossain