ভারতের ইসরোর বিজ্ঞানীরা যখন তাদের চন্দ্রাভিযানের ল্যান্ডিং মডিউল চন্দ্রযান-৩ ‘বিক্রমের’ চন্দ্রে অবতরণের ফাইনাল ল্যান্ডিং ট্র্যাজেক্টরি পরিমাপ করছে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তখন খাইবার-পাখতুনখাওয়া প্রদেশের পশতু গ্রামে এক পাহাড়ের গভীরে একজন বয়ষ্ক ও সাতজন মাদ্রাসা ছাত্রকে আকাশ থেকে মাটিতে নামানোর ল্যান্ডিং ট্র্যাজেক্টরি পরিমাপ করছিল। গত ২৩ তারিখে আমাদের ভাই ব্রাদার এই দুই দেশের এই দুটো খবরই ছিল বিশ্ব মিডিয়ার ব্রেকিং নিউজ। ঐ সাতজন হাতে বানানো এক প্রাইভেট কেবল কারে করে এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়ে স্কুলে যাচ্ছিল। ওই দিন সকালে সেটা দুই পাহাড়ের মাঝখানে পৌছালে কেবল কারের দুটি কেবলের একটি ছিঁড়ে যায় এবং সাত কিশোরকে নিয়ে কেবল কার বা খাঁচাটি একটি মাত্র তারের উপর ঝুলতে থাকে। মাটি থেকে ৯০০ ফুট উঁচুতে পাহাড়ের চুড়া থেকে দেড় কিলোমিটার দুরে ঝুলতে থাকে সাতজন আতঙ্কিত বিহ্বল কিশোর।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে অনেক সময় ক্ষেপনের পর পাক সামরিক বাহিনীর কমান্ডোরা আসে হেলিকপ্টার থেকে ড্রপ কেবলে ঝুলে তাদের উদ্ধারে। এভাবে একজনকে তারা যে প্রক্রিয়ায় নামায় সেটা দেখে ভয় পেয়ে যায় অন্যরা। পাক সেনা কমান্ডোরা বাকিদের নামাতে গেলে তারা আর কেউ রাজি হয় না ভেস্ট পরে হেলিকপ্টারে বাধা ইস্পাতের দড়িতে ঝুলে নামতে। অনেক অনুনয় বিনয় করে পাক সামরিক কমান্ডোরা, কিন্তু যথারীতি সেনাদের বিশ্বাস করে না শিশুরা। এ পর্যন্ত সব যুদ্ধে হারার মত এটাতেও হারে পাকিস্তানের সেনারা। কিন্তু হারলেও তারা পথ ছাড়ে না। এদিকে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসে। ঐ অঞ্চলের সাধারণ মানুষেরা চায় নিজেরা উদ্ধারকাজ শুরু করতে। অন্ধকার হয়ে গেলে পাক সেনারা তাদের মিশন স্থিগিত করে। ঐ অঞ্চলের সাধারণ মানুষদের মধ্যে হালকা পাতলা দেহের দুজন সাহসী লোক একটি প্রাইভেট সংস্থার সহযোগীতায় তাদের নামিয়ে আনে। দুজনের মধ্যে একজন একজন করে তখন জিপ লাইন (রশির সাথে আংটা পুলি) ব্যবহার করে তার বেয়ে ঝুলন্ত কারে পৌছায় এবং একজন একজন করে বাকি ছয়জনকে নামিয়ে আনে।
ভারতীয় চন্দ্রাভিযানের সফলতায় ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থা ইসরোর বিজ্ঞানীরা যখন সারা দুনিয়ায় প্রশংসিত হচ্ছেন, তখনই অনেকে আমাদের মহাকাশ বিজ্ঞান সংস্থা স্পারসোর সাথে তার তুলনার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। তারা ভুলে যাচ্ছে ভারত কিন্তু পারমানবিক ওয়ারহেড বহনকারী আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপনাস্ত্র (আইসিবিএম) উৎপাদনকারী দেশ। পারমানবিক ওয়ারহেড বহনকারী আইসিবিএম অগ্নি-৫ আট হাজার কিলোমিটার দুরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। মধ্য দুরত্বের (এমআরবিএম) অগ্নি-১ তারা সফলভাবে পরিক্ষা করেছিল সেই ১৯৮৯ সালে। নিজস্ব প্রযুক্তিতে যারা আইসিবিএম বানাতে পারে তারা চেষ্টা করলে এবং বাজেট পেলে চন্দ্রযান, এমনকি মন্যুষ্য যানও (ম্যানড ফ্লাইট) পাঠাতে পারবে যদি জ্ঞান, মানব দক্ষতা, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা, এবং রাষ্ট্রীয় দক্ষতা এগুলো ইতিবাচক দিকে প্রবাহিত হয়।
পাকিস্তানের আইসিবিএম না থাকলেও এমআরবিএম আছে শাহিন-৩ নামে যেটার রেঞ্জ ২৭০০ কিলোমিটার। মিসাইল থাকলেও পাকিস্তানের অনেক বিচ্ছিন্ন বিশ্লেষক ও পাকিস্তান বিশেষজ্ঞ তাদের বই পত্রে লিখেছেন যে পাকিস্তানের জাতীয় জ্ঞান, মেধা ও দক্ষতা গত ত্রিশ বছরে মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞান ফ্যাকাল্টির ছাত্ররা ধর্মীয় বিষয় প্রমানে পিএইচডি সম্পন্ন করেছে। আমরাও পিছিয়ে নেই। শুনেছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান ফ্যাকাল্টি বিবর্তনবাদ মিথ্যা এমন একটি বিষয়ে একজনকে পিএইচডি ডিগ্রি দিয়েছে।
আমার নিয়মিত পাঠকেরা জানেন বেশ কিছুদিন থেকেই আমি বাংলাদেশের সরকারী প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এমনকি বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জ্ঞান, মেধা ও দক্ষতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির চরম অবনমনের কথা লিখছি। আশ্চর্য হচ্ছে এখন সেটা দেশে অবস্থিত বিদেশী প্রতিষ্ঠান, জাতীসংঘের প্রতিষ্ঠানগুলো এমনকি অনেক দাতা সংস্থার স্থানীয় অফিসগুলোতেও দেখা যাচ্ছে। এই অবনমন বিষ্ময়কর।
কেন এমন হচ্ছে? এই ধাঁধা সমাধানের সূত্র পেয়েছি অ্যাপেলের প্রাক্তন সিইও স্টিভ জবসের কথায়। জবস একটি ইন্টারভিউতে বলেছিলেন বেশিরভাগ কাজে মানুষের দক্ষতার পরিসীমা দ্বিগুনের মধ্যে সীমিত থাকে। যেমন নিউইয়র্ক শহরের একজন গড়পড়তা ট্যাক্সিচালক এবং সেরা ট্যাক্সিচালকের দক্ষতার ফলাফলের তফাত দ্বিগুনের বেশি নয়। যেমন গড়পড়তা চালক যে সময়ে আপনাকে কোথাও নিয়ে যাবে, সেরা ট্যাক্সিচালক আপনাকে হয়ত তার শতকরা ৩০ ভাগ কম সময়ে নিয়ে যাবে। জবস বলেছিলেন কিন্তু সবকিছুর ক্ষেত্রে বিষয়টা এমন নয়। যেমন সফটওয়্যার তৈরীর ক্ষেত্রে একজন গড়পড়তা প্রোগ্রামার ও একজন সেরা প্রোগ্রামারের মধ্যে ফল পার্থক্য ৫০ গুন, এমনকি ১০০ গুন হয়ে থাকে।
স্টিভ জবস এদের বলে যে ‘এ’ প্লেয়ারর্স যারা সত্যিতারের প্রতিভাসম্পন্ন। স্টিভ জবস বলে আমার জীবনে যে সব সফলতা এসেছে সেটার কারন হচ্ছে আমি এইসব প্রতিভাসম্পন্ন ‘এ’ প্লেয়ারদের খুঁজে বের করেছি এবং ‘বি’ এবং ‘সি’ প্লেয়ারদের নিয়ে সন্তুুষ্ট থাকিনি। স্টিভ জবস আরো বলে আমি এটাও খুঁজে পেয়েছি যে যদি আমরা কয়েকজন ‘এ’ প্লেয়ারকে খুঁজে একত্র করতে পারি তাহলে তারা একসাথে কাজ করতে খুবই পছন্দ করে কারন এমন সুযোগ তারা আগে কখনও পায়নি এবং তাদের সবকিছু সফলতা লাভ করতে থাকে। জবস বলে এই ‘এ’ প্লেয়াররা ‘বি’ এবং ‘সি’ প্লেয়ারদের সাথে কাজ করতে পছন্দ করে না। এর ফলে তারা একধরনের আত্ম পুলিশিং করতে থাকে এবং আরো ‘এ’ প্লেয়ার নিয়োগ করতে থাকে। নিয়োগকর্তা হিসাবে স্টিভ জবস অন্য এক যায়গায় বলে "স্মার্ট লোকদের নিয়োগ করে তাদের কী করতে হবে সেটা বলে দেবার কোন মানে হয় না; আমরা স্মার্ট লোকদের নিয়োগ করি যাতে তারা আমাদের বলতে পারে কি করতে হবে।"
এখন প্রশ্ন হচ্ছে নিয়োগকর্তা যদি ‘এ’ প্লেয়ার না হয় তাহলে কি হয়। গাই কাওয়াসাকি একজন আমেরিকান মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ, লেখক এবং সিলিকন ভ্যালির ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট। তিনি ১৯৮৪ সালে অ্যাপেল ম্যাকিন্টোশ কম্পিউটার টিমের একজন ছিলেন যিনি বিপণন দেখতেন। গাই কাওয়াসাকি স্টিভ জবসের উধৃতি দিয়ে বলেন যে নিয়োগকর্তা যদি ‘এ’ প্লেয়ার না হয়ে ‘বি’ প্লেয়ার হয় তাহলে সে ‘সি’ প্লেয়ার নিয়োগ করে। সে যদি ‘সি’ প্লেয়ার হয় তাহলে সে ‘ডি’ প্লেয়ার নিয়োগ করে। এর ফলে ক্রমান্বয়ে সেই কোম্পানী ‘জেড’ প্লেয়ারে নিয়োগ পর্যন্ত চলে যায়। একে বলা হয় “বোজো এক্সপ্লোশন” যার অর্থ কোম্পানীটির নির্বুদ্ধিতার একাকার হয়ে যাওয়া।
কিন্তু একটি কোম্পানী তো নির্বুদ্ধিতার রাজ্য হতে পারে না কারন নির্বোধেরা অর্থলাভে দক্ষ হতে পারে না। হ্যাঁ ব্যবসা পরিবেশ নির্বোধদের জন্য নয়। গাই কাওয়াসাকি বলেছেন তবুও বোজো এক্সপ্লোশন হয় এবং সবচেয়ে বেশি হয় একটি কোম্পানী যখন আইপিও ঘোষনা করে পাবলিক হয়ে যায়। অর্থাৎ অগাধ টাকা বা 'ফ্রি মানি' “বোজো এক্সপ্লোশন” ঘটাতে পারে।
বাংলাদেশের দিকে তাকালে আমরা দেখব আমাদের নিয়োগকর্তারা ‘ডি’ প্লেয়ার। আমার মনে হয় ‘ডি’ প্লেয়াররা ‘ই’ প্লেয়ার বাছাই করেন না, ‘ডি’ প্লেয়াররা ‘এইচ’ প্লেয়ার বাছাই করেন, ‘এইচ’ প্লেয়াররা ‘পি’ প্লেয়ার বাছাই করেন। অর্থাৎ অবনমনটা এক্সপোনেন্সিয়ালি ঘটতে থাকে। বাংলাদেশের এই বিষ্ময়কর অবনমন এক্সপোনেন্সিয়ালি ঘটা শুরু হয়েছে এবং সেটা শুরু করেছে কাজ যেমনই হোক বেতন পাক্কা যে সব সেক্টর সেগুলো থেকে প্রথম। ‘এ’ প্লেয়াররাই শুধু ‘এ’ এবং ‘এ’ প্লাস প্লেয়ারদের চিনতে পারে। একজন ‘ডি’ ‘ই’ ‘এইচ’ বা ‘পি’ প্লেয়ার ‘এ’ প্লেয়ারকে চিনতে পারে না, নির্বোধ বা আঁতেল ভাবে। আবার ‘এ’ প্লেয়াররা ‘ডি’ ‘ই’ ‘এইচ’ বা ‘পি’ প্লেয়ারদের সাথে কাজও করতে পারে না। ফলেই বর্তমানের এই বাংলা বোজো এক্সপ্লোশন।
উপমহাদেশের সরকারী অফিসগুলোতে এই বোজো এক্সপ্লোশন কম বেশি ছিল (যেহেতু বেতন পাক্কা) কিন্তু পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এই সাম্প্রতিক বোজো এক্সপ্লোশনের কারন হচ্ছে সেনা সংস্কৃতিতে অভ্যস্তদের প্রতিষ্ঠানপ্রধান হয়ে যাওয়া এবং পরেক্ষভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় আসা। (চলবে)