আমার পাঠকেরা অনেকে অনুরোধ করেন দেশের অর্থনীতি নিয়ে লিখতে। লিখতে গেলে আমি শুধু প্যারাডক্স দেখি, মানে অর্থনীতির ত্রিশঙ্কু অবস্থা দেখি। ভারতীয় পুরাণ মতে রাজা ত্রিশঙ্কু জীবিত অবস্থায় স্বর্গে যেতে মনস্থ করেন এবং এর জন্য তিনি বিখ্যাত এক ঋষি বিশ্বামিত্রের শরণাপন্ন হন। বিশ্বামিত্র মহা উৎসাহে নিজের শক্তিমত্তা প্রদর্শনে তপস্যা ও যজ্ঞানুষ্ঠানের মাধ্যমে ত্রিশঙ্কুকে আকাশপথে স্বর্গে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু বাধ সাধেন স্বর্গের দেবতারা।
তারা এটায় রাজি নন। তখন দেবরাজ ইন্দ্রের নেতৃত্বে তাঁরা ত্রিশঙ্কুকে আবার মর্ত্যপথে ঠেলে দিলেন। এদিকে ইজ্জতের প্রশ্ন, তাই বিশ্বামিত্রও ত্রিশঙ্কুকে পৃথিবীতে নামতে দিতে নারাজ। তখন দেবতারা পড়লেন উভয় সংকটে। ভীত ও বিপন্ন দেবতাগণ তখন বিশ্বামিত্রের কাছে নিজেদের মান রক্ষার আবেদন জানালেন। এ অবস্থায় বিশ্বামিত্র সিদ্ধান্ত নিলেন, ত্রিশঙ্কু তাহলে আকাশ আর পৃথিবীর মধ্যখানে অবস্থান করুক। অতঃপর বিশ্বামিত্র ত্রিশঙ্কুর থাকার জন্য শূণ্যে নতুন এক নক্ষত্রলোক সৃষ্টি করে দিলেন।
কিন্তু আমাদের অর্থনীতির কেন এই ত্রিশঙ্কু অবস্থা? বেতন বাড়লে জিডিপি বাড়ছে সবইতো ভালো কথা। কিন্তু মানুষ অনুভব করছে কিছু একটি গড়বড় আছে। এটা নিয়ে কথা বলতে গেলেই মানুষের মনে আসে বিদেশে অর্থ পাচার, ঋণ খেলাপী, দুর্নীতি, স্বজনপ্রিয়তা এইসব কারণগুলো। আমার মতে এগুলো কারণ তবে এগেলোর কোনটাই প্রধান কারণ নয়। প্রধান কারণ হল আমাদের নীতিনির্ধারকদের নির্বুদ্ধিতা। পদ্ধতিগতভাবেই দ্রুত অর্থনৈতিক ‘উন্নয়ন’ আমাদের গলায় ফাঁস হবে। বিদেশে অর্থ পাচার, ঋণ খেলাপী, দুর্নীতি, স্বজনপ্রিয়তা এইসব না থাকলে আমরা আরো দ্রুত অর্থনৈতিক ত্রিশঙ্কু অবস্থা পড়ব।
এর কারণ আমাদের সরল অর্থনীতি ও উৎপাদন ব্যবস্থা। যে কোন দেশের সরল অর্থনীতি ও উৎপাদন ব্যবস্থা যে হারে জটিল অর্থনীতি ও উৎপাদন ব্যবস্থায় পরুবর্তিত হচ্ছে তার চেয়ে দ্রুত হারে যদি তারা অর্থনীতিকে এগিয়ে নেবার চেষ্টা করে তাহলে তারা অর্থনীতির আপার্তবৈপরীত্য বা প্যারাডক্সিক্যাল অবস্থায় পড়বে। এই সমস্যায় আমরা পড়ে গেছি। এই সমস্যায় পড়ার পর আমাদের উচিৎ ছিল দেশের অর্থনীতি ও উৎপাদন ব্যবস্থাকে সহায়তা করে বিপণন অর্থনীতির গতি ধীর করা। সেটা না করে আমরা মুক্ত বানিজ্যে সহায়তা করে, দেশে লুটপাটের অর্থনীতি চালু করে, উৎপাদন ব্যবসা আরো কঠিনতর করে উৎপাদন নয়, বিপণন নির্ভর অর্থনীতিতে সহায়তা করেছি শুধুই অতিরিক্ত করের লোভে। মানুষ কর দেয় না এই ধুয়ো তুলে ব্যবসায় জটিলতা না বুঝে যে কর বেশী দেয় সেই কর-বাহাদুর তৈরির সরল ব্যবসাকে প্ররেচিত করেছি।
একবার নাসিরুদ্দিন হোজ্জার শহরের যে কাজী তিনি বিচার করতে করতে অতিষ্ট হয়ে ঘোষনা দিলেন যে শহরে মিথ্যাবাদীর সংখ্যা অনেকে বেড়ে গেছে। তিনি নির্দেশ দিলেন শহরের প্রধান দুয়ারের সাথেই একটি ফাঁসীর মঞ্চ বানাতে। শহরে যত লোক ঢুকবে প্রথমেই তাদের জেরা করা হবে, মিথ্যা বললেই সাথে সাথে ফাঁসী। হোজ্জা কি কারণে যেন সে রাত শহরের বাইরে গিয়েছিলেন। সকালে সরল মনে শহরে ঢুকতে গিয়েই কঠোর জেরা প্রহরীর "অ্যাই ব্যাটা হোজ্জা, এই সাত সকালে কোথায় যাওয়া হচ্ছে? হোজ্জার শান্ত নির্লিপ্ত উত্তর "ফাঁসীতে ঝুলতে"।
সিপাহী শাস্ত্রীরাতো রেগে আগুন, ব্যাটা, সাত সকালে কাজীর প্রহরীদের কাছে মিথ্যা বলা হচ্ছে? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা বলেই সোজা তাকে নিয়ে গেল ফাঁসীর মঞ্চে, গলায় পরাল ফাঁসীর রশি। কোন রকমে ঢোক গিলতে গিলতে হোজ্জা বলল "এটাই তো বলেছিলাম, আমার কথা সত্য হলো তো?" কাজীর প্রহরীরাতো পড়ল মহা বিপদে। ফাঁসী দিয়ে দিলে হোজ্জা হয়ে যায় সত্যবাদী, আর ফাঁসী না দিলে হোজ্জা হয় মিথ্যাবাদী। তারা বুঝল এই আইনে সমস্যা আছে। তারা হোজ্জাকে ধরে নিয়ে গেল কাজীর সামনে। কাজী ফিরিয়ে নিল তার আদেশ। মুক্ত হল হোজ্জা কারণ এই পথে মিথ্যুক আর সত্যবাদী নির্ণয় করা অসম্ভব। মিথ্যুক আর সত্যবাদী নির্ণয় করতে না পারার এই পরিস্থিতিটা একটা আপার্তবৈপরীত্য বা প্যারাডক্সিক্যাল অবস্থা। এর কোন সরল সমাধান নেই।
অতীব সুন্দরী যে সব মেয়েরা তাদের অনেকেরই অতীব চরম কিছু চরিত্রগুন থাকে যেটা অনেক মানুষই গ্রহণ করতে পারে না। যেমন সুপার মডেলেরা। শোনা যায় তাদের যে মেজাজ মর্জি, সেটা গ্রহণ করতে পেশাগত দক্ষতা লাগে। সমস্যা হল মোটেই সুন্দরী নয় এমন অনেকেরও সেই অতীব চরম চরিত্রগুনগুলো থাকতে পারে। আমার অবস্থা হয়েছে অনেকটা সেরকম। আলবার্ট আইনস্টাইন বিখ্যাত ব্যক্তি। তার মেধা ও জ্ঞান অসীম। আইনস্টাইনের ভাল গুণগুলো আমারে একেবারেই নেই, কিন্তু অল্প বয়সে তাঁর যে সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কল্পনার নৌকা ভাসানোর খায়েশ ছিল, সেটা আমার মধ্যে পুরোপুরি আছে। আইনস্টাইন এটার বৈজ্ঞানিক নাম দিয়েছিলেন কল্প পরীক্ষা বা থট এক্সপেরিমেন্ট। আসুন একটা থট এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে বুঝি আমাদের অর্থনীতির আপার্তবৈপরীত্য বা প্যারাডক্সিক্যাল অবস্থাটা ঠিক কোথায়।
থট কনটেক্সট ১: কল্পনা করুন একটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ম্রু গ্রাম। এই গ্রামের জীবনযাপন ও সংস্কৃতি এমন যে তারা কোন কিছু কেনে না। ম্রু জনগোষ্ঠির নারী পুরুষ উভয়েই ঝুম চাষ করে, তারা ঝুমে শস্য দানা ও সবজি চাষ করে, হার্ব মানে মসলা গাছ রোপন করে, কলা ও অন্যান্য ফলের গাছ রোপন করে। পহাড়ে তারা তুলারও চাষ করে, পশু পালন করে এবং তারা রান্নায় তেল ব্যবহার করে না। এক অর্থে তদের প্রতিটি পরিবার খাদ্য ও পোশাকে স্বয়ং সম্পূর্ণ। তারা যে মদ্যপান করে সেটাও তারা নিজেরা বানায়।
আপনি যদি একটি ম্রু গ্রামে যান এবং তাদের গৃহমধ্যে প্রবেশ করেন তাহলে দেখবেন তাদের ঘরের প্রায় সব জিনিষ পত্র যেমন বাদ্যযন্ত্র থেকে মাছ ধরার বা মদ্য চোলাইয়ের যন্ত্র সবই নিজেদেরই বানানো। এরকম একটি ম্রু গ্রাম যদি তাদের জিডিপি বৃদ্ধি করতে চায় তাহলে কোন সমস্যা নেই। সবাই আরো বেশী পরিশ্রম করবে, ভাল খাবে ভাল পরবে এবং জিডিপি বৃদ্ধিতে তাদের পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
থট কনটেক্সট ২: এবার ধরা যাক ঐ ম্রু গ্রামের একটি ছেলে পড়ালেখায় ভাল ফল করল। তারপর সে বান্দরবান শহরের একজন স্কুল শিক্ষক হল। এখন তার আর শুধু ম্রু জীবনযাপন করলে চলে না। তাকে সমতলের যে সংস্কৃতি সেটাও মেনে চলতে হয়। কাজের ব্যস্ততায় তার এখন সময় নেই সবকিছু নিজে করার। ঝুম জাষ তো দুরের কথা, প্রতি বেলায় রান্না করতে সময় হয়না বলে তার একটি ফ্রিজ দরকার। কাপড় ইস্ত্রি করার জন্য একটি ইলোকট্রিক ইস্ত্রি দরকার, খবর দেখার জন্য একটি টিভি দরকার। এর অর্থ হচ্ছে তার এখন অনেক কিছু দরকার যেগুলো অন্য মানুষ তৈরী করে এবং যেগুলোর কাঁচামাল অন্য মানুষ সরবরাহ করে।
থট কনটেক্সট ৩: ধরা যাক ঐ ম্রু গ্রামের আর একটি মেয়ে পড়ালেখায় আরো অনেক ভাল ফল করল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে খুব ভাল ফল করার পর ইউএনডিপিতে সে উচ্চ বেতনে চাকুরি পেল। ঢাকায় সে অভিজাত এলাকায় থাকে। অফিস থেকে তাকে গাড়ি দিলও তার একটা নিজস্ব গাড়ি দরকার। তার বাড়িতে গেলে দেখা যাবে যে প্রচুর দামী আসবাব ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম। তার টয়লেট ও কিচেন আধুনিক ও ওয়েল ফার্ণিশড। তার বাড়িতে বেশিরভাগ জিনিষ বিদেশী। এর অর্থ হচ্ছে তার এখন অনেক কিছু দরকার যেগুলো শুধু দেশ নয়, বিদেশী মানুষেরা তৈরী করে এবং যেগুলোর কাঁচামাল বিদেশীরা সরবরাহ করে।
এখন থট কনটেক্সট ১ পরিস্থিতিতে ঐ সমাজে অর্থের কোন প্রয়োজন নেই। খুব বেশি হলে তারা পণ্য বিনিময় করেই সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারে। থট কনটেক্সট ২ পরিস্থিতিতে ঐ সমাজে যথেষ্ট টাকা উপার্জন করতে হবে যাতে সমাজে সে যে ইনপুট দিচ্ছে তার বিনিময়ে প্রয়োজনীয় প্রোডাক্ট ও সার্ভিস সে ক্রয় করতে পারে। অপর দিকে থট কনটেক্সট ৩ পরিস্থিতিতে ঐ সমাজে যথেষ্ট বৈদোশিক মূদ্রা থাকতে হবে যাতে তারা যে আয় করছে তার বিনিময়ে সে বিদেশী প্রোডাক্ট ও সার্ভিসগুলো ক্রয় করতে পারে।
আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার যত উন্নতি হয় আমাদের ততই জটিলতর পন্যের প্রয়োজন হয়। সেই জটিলতর পণ্য বা সেবা যদি আমি উৎপাদন না করতে পারি তাহলে সেটা কিনতে টাকার প্রয়োজন হয় এবং সেই জটিলতর পণ্য যদি দেশে উৎপাদিত না হয় তাহলে আমাদের বৈদেশীক মূদ্রার প্রয়োজন হয়। যে হারে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ণ হচ্ছে (যেমন জিডিপি গ্রোথ), সেই হারে যদি দেশের উৎপাদনব্যবস্থা জটিলতার বৃদ্ধি না হতে থাকে তাহলে দেশীয় অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি ও বিদেশী মূদ্রার সংকট তৈরি হবে।
আমরা যে ম্রু গ্রাম নিয়ে থট এক্সপেরিমেন্টে করলাম এই কিছুদিন আগেও পুরো বাংলাদেশ এমন ছিল। গ্রামগুলোতে ৯৫ ভাগ ব্যবহার্য মানুষকে কিনতে হত না। আর্থিক উন্নতি, জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও উৎপাদনব্যবস্থার ব্যবসায়ীকরণ আমাদের সর্বস্তরের জীবনযাত্রাকে মার্কিন ডলার নির্ভর করছে। এখন ধান উৎপাদনে লাগে বিদ্যুৎ, মাছ ধরতে পরিবহণ লাগে ডার কাঁচামাল বিদেশী কয়লা বা আমদানী করা ডিজেল। লেখাটা পড়া থামিয়ে আপনার দৈনিক বাজার ও আপনার বাড়ির জিনসপত্রের দিকে তাকিয়ে দেখুন কতগুলো জিনিষ বা তার কাঁচামাল আসে বিদেশ থেকে। সর্বত্রই আপনি দেখবেন অনেক $$$ চিহ্নের লেবেল।
অর্থাৎ আমাদের দেশে আমরা যত অর্থনৈতিক উন্নতি করব আমাদের তত বৈদেশিক মূদ্রা লাগবে এমন কি সিম্পল ভাতে মাছে বাঙালী থাকতে গেলেও। এর সমাধান হচ্ছে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থাকে জটিলতর করার জন্য দীর্ঘস্থায়ী সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা। দেশের অর্থনীতি বা উৎপাদন ব্যবস্থাকে জটিলতর করতে গেলে সবার আগে লাগে প্রডাক্ট তৈরির নো-হাও বা উৎপাদন জ্ঞান ও উৎপাদন সহায়ক ইকোসিস্টেম। এই দুটেতেই দেশ চলছে বিপরিত দিকে। উৎপাদন জ্ঞান যাদের আছে তাদের বাদ দিয়ে বিপণনকারীরা এখন জাতির নীতিনির্ধারণের নিয়ন্তা। উৎপাদন সহায়ক ইকোসিস্টেম অর্থ অর্থনৈতি অঞ্চল আর অবকাঠামো নয়, উৎপাদন সহায়ক ইকোসিস্টেম হল ছোট ব্যবসা ও ক্ষুদ্র উৎপাদকদের সর্বাত্মক সহযোগীতার পরিবেশ। রাষ্ট্রের সকল স্তরের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো বৃহৎ গ্রুপগুলোর গোলাম আর ক্ষুদ্র উৎপাদকদের জন্য রাক্ষসে পরিণত হয়েছে। ক্ষুদ্র উৎপাদকদের সর্বাত্মক সহযোগীতার পরিবেশ তৈরি না করে টাকা ছাপিয়ে উন্নয়নের ডিসপ্লে তৈরী করে যে মুদ্রাস্ফীতি তৈরী করা হয়েছে সেটা উৎপাদন নিরোধোক ইকোসিস্টেম। যা দেশের উৎপাদনব্যবস্থা জটিলতর হবার অন্তরায়।
ছবি: হার্ভাড বিশ্ববিধ্যালয়ের গ্রোথ ল্যাবের সহযোগীতায় তৈরি করা জাপান, ভুটান ও বাংলাদেশের উৎপাদনব্যবস্থার জটিলতার ম্যাপ। তুন দেশের তুলনামূলক চিত্র এখানে। খাদ্য, পোশাক এগুলো অতি নিম্ন উৎপাদন জটিলতার পন্য, অপরদিকে গাড়ি বা অটোমোবাইল, ইলেকট্রনিক্স (সংযোজন নয়) উচ্চ উৎপাদন জটিলতার পন্য কারণ এগুলো উৎপাদনের সাথে লম্বা তালিকার সাপোর্ট ইন্ডাস্ট্রী জড়িত থাকে।
পাঠকেরা চাইলে এই বিষয়ে আরো লিখতে পারি।