EN
আরও পড়ুন
ধর্ম ও দর্শন
গ্লোবালিস্টদের উদ্যোগ ও সহায়তায়
গবেষণা
বহুকাল দারিদ্র ও অপুষ্টিতে ভোগা সমাজের হঠাৎ ধনী হয়ে যাওয়া
রাজনীতি
মিয়ানমার নিয়ে বিপজ্জনক খেলা
রাজনীতি
বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য দীর্ঘমেয়াদে গুরুতর হুমকি
রাজনীতি
JadeWits Technologies Limited
রাজনীতি

হামাসের হামলা - পরিণতি কি?

মধ্যপ্রাচ্যের পার্ল হারবার

যুদ্ধ মানেই বিভীষিকা, এমনকি যে জিতে তার জন্যও। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার পর আমেরিকা আন্তর্জাতিক সংঘাত থেকে নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নেয়। যেহেতু আমেরিকা বাকি দুনিয়া থেকে বিশাল দুটো মহাসাগর দিয়ে বিচ্ছিন্ন, ভূপ্রকৃতিগত কারনেই আমেরিকা একটি নিরাপদ এলাকা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হয়ে যায়। তারা অন্য দেশের জন্য যুদ্ধে যাবে না এমন সিদ্ধান্ত নেয় এমনকি তারা যুদ্ধরত দেশে অস্ত্র সরবরাহও করবে না এমন আইনও পাশ করে। মার্কিন কংগ্রেস এই সময় বেশ কিছু অপক্ষপাত (নিউট্রালিটি) বিল পাশ করে। আমেরিকার এই শান্তুপ্রিয় নিরপেক্ষ অবস্থানের সুযোগে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ক্ষুদ্রতর উন্নাসিক একনায়কতন্ত্রগুলো। যার মধ্যে নেতৃত্বে পশ্চিমে জার্মানী ও ইটালি এবং পূর্বে জাপান।

প্রযুক্তি ও নৌ শক্তিতে জাপান সেরা হলেও ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্র জাপানের প্রাকৃতিক সম্পদ নেই বললেই চলে। তাদের প্রায় ৯৫ শতাংশ জ্বালানী আমদানী করতে হয়। কল কারাখানার জন্য কয়লা, ইস্পাত ও অন্যান্য ধাতব ও রাসায়নিক প্রায় সবই আমদানি করতে হয়। গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আত্মনিরাপদ অবস্থানের কারণে জাপান অন্য দেশের জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ লুটপাট করার জন্য দুটো নতুন কৌশল হাতে নেয়। এই কৌশলগুলো বাস্তবায়নের জন্য তারা একটি অভ্যন্তরীণ নীল নকশাও প্রণয়ন করে। প্রথমে তাদের প্রথা অনুযায়ী বিভিন্ন শিল্প অলিগার্ক তৈরি করে ও সরকারী অর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার ঐ সব অলিগার্কদের বিপুল অর্থ প্রদান করা হয়। ঐ সব অলিগার্কেরা সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগীতায় সংবাদ ও বিনোদন মাধ্যম ব্যবহার করে, প্রোপাগান্ডা চালিয়ে ও গোপন পুলিশ দ্বারা বিরুদ্ধমত দমন করে ক্রমেই সম্রাটকে মহামানবে পরিণত করে। এর পর সেই ‘মহামানব’ সম্রাটের সেবা করার জন্য বিশাল সংখ্যায় অন্ধ জাতীয়তাবাদী তরুণসমাজ তৈরীর দিকে মনোযোগ দেয়। এর সাথে তারা শক্তিশালী করতে থাকে জাপানের সেনা ও নৌ শক্তি। এরপর সেই অন্ধ জাতীয়তাবাদী তরুণসমাজ ও সামরিক শক্তি একত্র করে তৈরী হয় জাপানের সম্রাটের নৃশংস সেনা ও নৌ বাহিনী।

সম্রাটের নৃশংস সেনা ও নৌ বাহিনী তারপর সেই দুটো কৌশলের বাস্তবায়ন শুরু করে। সেগুলোকে বলা হয় জাপানের উত্তর ও দক্ষিন কৌশল। উত্তর কৌশলটি হল রাজকীয় সেনাবাহিনী ব্যবহার করে পূর্ব চীন, মঙ্গোলিয়া এবং সাইবেরিয়া দখল করে সেখানকার জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ হস্তগত করা। দক্ষিন কৌশলটি হল রাজকীয় নৌবাহিনী পাঠিয়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রগুলোন খনিজ এলাকা দখল করা যার অনেকগুলোই ডাচ, ইংল্যান্ড বা ফরাসীদের উপনিবেশ। প্রথম কৌশলে শুরুতে তারা অনেকটাই সফল হয় যার ফলে চীন-মঙ্গোলিয়ার মাঞ্চুরিয়া এলাকা তারা দখল করে নেয় এবং জাপানি রাজকীয় সেনাবাহিনী দ্বারা যেখানে ন্যানঝিং গণহত্যা ও গণধর্ষণ সংঘটিত হয়।

তখনকার সময়ের দরীদ্র ও কিছুটা অলস চীন প্রাথমিকভাবে জাপানের আক্রমণের কোন প্রতিরোধই তৈরী করতে পারে না। মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলের চীনের অংশ সহজেই দখল করে চীনের সীমানা অতিক্রম করে জাপানী বাহিনী মঙ্গোলিয়ার মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলে পৌছে যায়। ক্রমে চীন শক্তি সঞ্চয় করে সোভিয়েত-মঙ্গোলিয় বাহিনীর সাথে একত্র হয়ে জাপানকে মোকাবেলা করতে শুরু করে। ওই সময় জাপানের প্রায় আশি ভাগ জ্বালানী সরবরাহ হত আমেরিকা থেকে। জাপানি রাজকীয় সেনাবাহিনী দ্বারা চীনে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনে আমেরিকার জনগণ জাপানের প্রতি অবরোধ আরোপের ব্যপক দাবী তোলে। এর ফলে আমেরিকা জাপানের উপর জ্বালানী অবরোধ আরোপ করে এবং জাপানের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ফলতঃ জাপানের উত্তর কৌশল স্থগিত হয়ে যায়।

এর পর জাপান আমেরিকার বন্ধ করা ফলে উদ্ভুত জ্বালানী সঙ্কট কাটাবার জন্য দক্ষিন কৌশল বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। তারা রাজকীয় নৌ বাহিনীকে জ্বালানী সমৃদ্ধ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর দিকে পাঠাবার পরিকল্পনা করে। ঐ দ্বীপরাষ্ট্রগুলো অনেকগুলোই ডাচ, ইংল্যান্ড বা ফরাসীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকা তার অপক্ষপাত অবস্থান থেকে বের হয়ে এসে বৃটেন ও ফ্রান্সে অস্ত্র বিক্রয় মুক্ত করে। এর সাথে সাথে আমেরিকা বৃটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও কিছু গণতান্ত্রিক দেশে ‘ল্যান্ড এইড’ সহাযোগীতা বিল পাশ করে। যেটা ছিল আমেরিকার নিজের নিরাপত্তার জন্য ঐ সকল গণতান্ত্রিক মিত্র দেশগুলোকে বিনামূল্য খাদ্য, জ্বালানী ও অস্ত্র সগযোগীতা করতে পারবে এমন আইন।

উত্তর কৌশলে ব্যর্থ জাপান যখন দক্ষিণ দ্বীপরাষ্ট্রগুলো থেকে সম্পদ আহরণে রত, তখন তারা ইউরোপের আরো দুই একনায়ক রেজিম, জার্মানী ও ইতালীর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। ফলে আমেরিকা জাপানে যুদ্ধ শিল্পে ব্যবহার্য সকল কিছুতে রপ্তানি অবরোধ আরোপ করে। আমেরিকার অবরোধে উত্তর কৌশলে ব্যর্থ জাপান এখন দক্ষিণ কৌশলেও বিপদ দেখতে পায়। কিন্তু এত অবরোধেও তাদের শিক্ষা হয় না। তারা ফরাসী-ইন্দোচীনের আরো বৃহৎ অংশ দখল করা চালিয়ে যেতে থাকে। এর প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকা আমেরিকায় থাকা জাপানের সকল সম্পদ বাজেয়াপ্তের ঘোষণা দেয়। আমেরিকার এই সিদ্ধান্ত ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ড উভয়েই অনুসরণ করে এবং তারাও জাপানকে অবরোধ আরোপ করে। এর ফলে জাপানে ৯৪ শতাংশ জ্বালানী তেল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।

জাপান তখন চরম সমস্যায় পড়ে। আমেরিকার প্রতি তারা অবরোধ তুলে দেবার আহ্বান জানায়। আমেরিকা বলে বিনিময়ে চীন থেকে সম্পূর্ণ নিজেদের সরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু এতে সম্রাটের সম্মানহানী হবে তাই জাপান সেটা মানতে নারাজ। এই অবস্থায় তারা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ইন্দো-মালয় এলাকায় ব্যপক আক্রমণ শুরু করে ও সেগুলো দখল করতে থাকে। নিজের ক্ষমতায় মাতাল এবং অলিগার্ক ও তোয়াজকারী পরিবেষ্ঠিত সম্রাট তখন একটি মারাত্মক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়। সেটি হল হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্ল হারবারে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ও নৌ-ঘাঁটিতে অকস্মাৎ আক্রমণ করে বসা। তাদের ধারণা ছিল আমেরিকা কখনই বিশাল সমুদ্র পেরিয়ে তাদের মত এক শক্তিধর দেশের সাথে যুদ্ধ করার ঝুঁকি নেবে না। তাদের ধারণা ছিল পার্ল হারবারে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে যদি আমেরিকার প্যাসিফিক ফ্লিট ধ্বংস করে ফেলা হয় তাহলে আমেরিকা তাদের মিত্র ইংল্যান্ড, ডাচ বা ফরাসীদের ইন্দো-মালয় এলাকায় সহযোগীতা করতে পারবে না এবং সকলের চাপে আমেরিকা একটি সম্মানজনক শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হবে।

ক্ষুদ্র প্রাসাদ নিয়ন্ত্রিত একনায়ক জাপান রেজিম একটি বৃহৎ পরাশক্তির মানসিকতা পড়তে ভুল করেছিল। কয়েক বছর থেকে নিষেধাজ্ঞা দিতে থাকা আমেরিকা নিশ্চই মিত্রদের সহযোগীতার কথাই শুধু চিন্তা করে নাই। একটি পরাশক্তি তার নিজের নিরাপত্তার জন্য তার যা যা করা দরকার সেটা করবে। পার্ল হারবারে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে জাপান আমেরিকার প্যাসিফিক ফ্লিট ধ্বংস করেছে ঠিকই কিন্তু জপানীদের মগজে যে শান্তি চুক্তির ধারণা ছিল আমেরিকার তার ধারে কাছেও যায়নি। পরদিনই আমেরিকার প্রসিডেন্ট মার্কিন কংগ্রেসে তার ‘কুখ্যাত দিন’ (ডে অব ইনফেমি) ভাষণটি দেন এবং কংগেসের কাছে জাপানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণার অনুমতি চান। কংগ্রেস অনুমতি দিলে আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে লিপ্ত হয় এবং সম্রাটের ইগো দমন করতে দুটি পারমাণবিক বোমার আঘাতের প্রয়োজন হয়।

চার দিন আগে গত শনিবার, ৭ অক্টোবর ২০২৩, পার্ল হারবারের মতই ইসরাইলে আকস্মিক আক্রমণ করেছে প্যালেস্টাইনের হামাস। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সকল সুস্থ মানসিকতার মানুষদের সহানুভূতি ও সমর্থন রয়েছে। কিন্তু এই কয়েক দিনে হাজার হাজার মানুষের হতাহতের লক্ষ্য কি? সামনের দিনগুলোতে গাজায় প্যালেস্টাইনবাসীর জন্য যে ভয়ংকর সময় অপেক্ষা করছে সেটা মোকাবেলার কৌশল কি? এই আক্রমনের চুড়ান্ত লক্ষ্য কি, পরিণতি কি? কতটুকু বৃহৎ পরিসরে হামাস চিন্তাভাবনা করেছে? তারা কি শুধু ইসরাইলকে নিয়ে চিন্তা করেছে যে তাদের কিছু অধিবাসীদের জিম্মি করতে পরলে ইসরাইল দর কষাকষিতে বাধ্য হবে?

তারা কি ভেবেছে আমেরিকা ও অন্য বৃহৎ শক্তিগুলো কি ভাবছে ছোট্ট একটি অস্ত্রধারী জনগোষ্ঠীর এমন ঝটিকা আক্রমণ নিয়ে? বৃহৎ শক্তিগুলো যদি এমন ঘটনাকে তাদের জনগণের জন্য মারাত্মক নিরাপত্তা হুমকি ভাবে তাহলে এত গর্বের হামলার পরিণতি কি পার্ল হারবারের মতই হবে না? এই হামলায় পশ্চিমা বিশ্ব সহ অনেক দেশের নিরাপরাধ নাগরিকেরা নিহত হয়েছে। এর ফলে উক্ত দেশগুলো আইনগতভাবে ইসরাইলের পক্ষ হয়ে ইসরাইলকে সহযোগীতা করতে বাধ্য। ঘটনাটিকে এর মধ্যেই আমিরকার টুইন টাওয়ার হামলার ৯/১১ ঘটনার অনুরূপ লেবেল দেওয়া হয়েছে। সামনে কি আর একটি ‘ওয়ার অন টেরর’ আমরা দেখব না?

আমার মনে হয় এটা ফিলিস্তিন জনগনের নিরাপত্তা ও দীর্ঘস্থায়ী কল্যানের কথা চিন্তা করে সুচিন্তিত কোন আক্রমণ নয়। মনে হচ্ছে যেন আমেরিকার প্ররোচনায় ও স্বার্থে নির্বোধ জেলেনেস্কির নেতৃত্বে ইউক্রেনের সাধারণ জনগণ যেমন সীমাহিন মৃত্যু, পঙ্গুত্ব ও দুর্ভোগের শিকার, ফিলিস্তিনের জনগনও তেমনই ইরান, সৌদি আরব, ইসরাইল ও আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে দখলের রাজনীতির বলি। এটা নিশ্চিৎ যে বিষয়টিকে শুধুই ইসরাইল-ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরস্থ সংঘাত হিসাবে দেখা হবে না। এটাকে এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক ঘটনা হিসাবে দেখার চেয়েও আর বড় হয়ে উঠবে বৃহৎ শক্তিগুলোর নিরাপত্তা ভীতি। তারা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যা দরকার সেটা করবে। এতে সকল ফিলিস্তিন নাগরিককে হ’ত্যা করতে হলে, তাই করা হবে।

JadeWits Technologies Limited
সর্বশেষপঠিতনির্বাচিত

আমরা আমাদের সেবা উন্নত করতে কুকি ব্যবহার করি। আমাদের কুকি নীতির শর্তাবলী জানার জন্য অনুগ্রহ করে এখানে ক্লিক করুন। কুকি ব্যবহারের জন্য আপনি সম্মত হলে, 'সম্মতি দিন' বাটনে ক্লিক করুন।