EN
আরও পড়ুন
প্রকৃতি ও সুরক্ষা
বিজ্ঞানের উপনিবেশবাদ ও তার দেশী তাবেদারেরা -২
প্রকৃতি ও সুরক্ষা
বিজ্ঞানের উপনিবেশবাদ ও তার দেশী তাবেদারেরা -১
ধর্ম ও দর্শন
শহুরে শিক্ষিত দালালদের শক্তিশালী করার কৌশল
ধর্ম ও দর্শন
JadeWits Technologies Limited
খবর ও সাম্প্রতিক ঘটনা

ইবনে খালদুনের আল মুকাদ্দিমা ও বাংলাদেশের অন্ধকার ভবিষ্যত - ২

দ্রব্যমূল্য, সিন্ডিকেট ও ধীরে ঘটা শ্রীলংকা

বিডিনিউজ২৪ডটকম সম্প্রতি লিখেছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য যে সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের ভাষায় সেটা ‘অদৃশ্য শক্তি’। মন্ত্রী বলেছেন, “বাজারের সিন্ডিকেট যদি দেখতে পারতাম, ধরতে পারতাম, তাহলে ব্যবস্থা নিতে পারতাম।” মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, “সিন্ডিকেট ধরা যায় না, অধরা থেকে যায়। তবে তা সাময়িকভাবে বাজারের ভেতরেই থাকতে পারে। সিন্ডিকেট হয়, সিন্ডিকেট ভাঙে, আবার নতুন সিন্ডিকেট হয়। বাজার নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি দুনিয়ায় কারোরই নেই। বাজার নিজেকেই নিজে নিয়ন্ত্রণ করে। “তবে কিছু অনুষঙ্গ আছে— সরবরাহ, চাহিদা। এগুলো নিয়ে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা যায়। আসল প্রশ্ন হল, একটা উদীয়মান অর্থনীতিতে সব সময় চাহিদা ও জোগানের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকে। স্থিতিশীল বুড়ো অর্থনীতিগুলোর বাজারে একটা ভারসাম্য আছে।"

বাংলাদেশের অর্থনীতি যে ‘উদীয়মান’, সে কথা তুলে ধরে পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেন, “এ ধরনের অর্থনীতিতে কিছু বিকৃতি থাকবেই, লাভ বা মুনাফার সুযোগ নেবেই। এটা মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন ধরনের নিয়ন্ত্রণ বা নিয়ামক সংস্থাকে বিধিবিধান প্রয়োগ করতে হবে।” মন্ত্রী আরো বলেছেন “আইনে যা আছে, সেটাকে মাঠে নেমে প্রয়োগ করতে হবে। এখানে কিছু ঘাটতি মাঝেমধ্যে হয়ে যায়। কয়েকটা নিয়ামক সংস্থা আছে, একেবারে নতুন। তাদের তো দাঁত গজাতে হবে। তারা আস্তে আস্তে অভিজ্ঞ হচ্ছে, কাজ করছে”। মন্ত্রী আরো বলেন, “গত দুই বছর আগে অনেকেই বলেছিলেন যে- বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে গেছে; শুধু বাঁশি বাজানো বাকি, সেটা হয়নি”।

এখন আমরা দেখি ইবনে খালদুন তাঁর আল মুকাদ্দিমা গ্রস্থে সিন্ডিকেট সম্পর্কে কি বলেছেন। আল মুকাদ্দিমার ত্রয়োশ্চত্বারিংশ (৪৩) পরিচ্ছেদ, “উৎপীড়ন সভ্যতার ধ্বংস ডেকে আনে” এর শেষ অনুচ্ছেদ ও মজুদদারী অংশে সিন্ডিকেট যে সরকার নিজেই, সেই বিষয়টি পরিষ্কার উঠে এসেছে।

ইবনে খালদুন লিখছেন, সাধারণ মানুষের উপর সবচেয়ে মারাত্মক ও ধ্বংসাত্বক সমাজবিরোধী উৎপীড়ন হল শাসক কতৃক অন্যায়ভাবে শ্রমিক নির্যাতন এবং প্রজাদের উপর কর্তব্যের ভার চাপিয়ে দেয়া। এমন একটা পরিস্থিতি যেখানে শাসকেরা কোন কিছুর দায় এড়িয়ে চলে। ইবনে খালদুন লিখছেন শ্রম, বলতে গেলে, শ্রমিকের পুঁজি স্বরূপ, সুতরাং তাদের প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম সামগ্রিকভাবে তাদের পুঁজি ও উপার্জনের ভিত্তি। এটা ছাড়া তারা জীবিকা অর্জনে সক্ষম হয় না। যে সকল প্রজা সভ্যতা নির্মাণে তাদের শ্রম প্রদান করে, তাদের জীবিকা ও উপার্জন তারই উপর নির্ভরশীল সুতরাং তাদেরকে যদি অন্যভাবে শ্রম দিতে বাধ্য করা হয় এবং তাদের জীবিকার ভিত্তিকে অন্যত্র নিয়োগ করা হয়, তা হলে তাদের উপার্জন হাস পায় ও তারা শ্রমের বিনিময় থেকে বঞ্চিত হয়। যেহেতু এটাই তাদের পুঁজি, কাজেই এরূপ ব্যবহারের ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাদের জীবিকার একটা বিরাট অংশ নষ্ট হয়ে যায়; বরং বলা যায়, তাদের জীবিকাই বিপন্ন হয়ে পড়ে । এরূপ ব্যবহার বারবার দেখা দিলে সভ্যতা বিনির্মাণে তাদের কামনা-বাসনা লোপ পায় এবং তারা সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা ত্যাগ করে বসে পড়ে । এতে সভ্যতার সংকোচ ও ক্ষতি সাধিত হয়। অর্থাৎ ইবনে খালদুন প্রথম উৎপীড়ন দেখেছেন শ্রমের মূল্য হ্রাস।

এর পর ইবনে খালদুন মজুদদারী অংশে লিখছেন, জনবসতির ও সাম্রাজ্যের ধ্বংস সাধনে এটা থেকেও মারাত্মক ধরনের উৎপীড়ন হল মানুষের পণ্যদ্রব্য স্বল্পমূল্যে ক্রয় করে তার উপর আধিপত্য বিস্তার করা এবং পুনরায় অতিরিক্ত মূল্য ধার্য করে তা বিক্রয় করা। এ উভয় ক্ষেত্রে জবরদস্তি ও ডাকাতির অনুরূপ ব্যবহার প্রয়োগ করা হয়। অনেক সময় তাদেরকে সহজ কিস্তিতে ও দেরিতে মূল্য প্রদানের সুযোগ দিয়ে অধিক মূল্যে পণ্য বিক্রয় করা হয়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের ক্রেতারা তাদের আপাত দৃশ্যমান ক্ষতিকে এ বলে মেনে নেয় যে, হয়তো এই অধিক মূল্যে ক্রয় করা পণ্যদ্রব্যের বাজারে তেজীভাব দেখা দেবে এবং তারা লাভবান হতে পারবে । কিন্তু মজুদদারের ঋণ শোধ করার জন্য তারা কম মূল্যেই পণ্য বিক্রয় করতে বাধ্য হয় এবং এই উভয় দিকের ক্ষতি তাদের মূলধনের উপর আঘাত হানে। এমন পরিস্থিতি কখনো নগরে বসবাসকারী, সেখানে আগত ক্রেতা বা বাজারের সর্বপ্রকার ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রেই দেখা দেয়।

ফলমূল ও খাদ্যদ্রব্যের দোকানী, এমনকি শিল্পপতিরাও যন্ত্রপাতি ও সহায়ক দ্রব্যাদির ক্ষেত্রে এমন দ্বিমুখী ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ফলে এটা সকল শ্রেণী ও স্তরে ছড়িয়ে যায় এবং ঘণ্টায় ঘণ্টায় মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। এটা মূলধনের (এবং শ্রমিকের আয়ের) উপর প্রচণ্ড আঘাত হানে এবং মূলধনের অভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর বাজার থেকে বের হয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। কারণ লাভের দ্বারা তার ক্ষতি পুষিয়ে নেবার কোনো আশা আর থাকে না। বিভিন্ন দিক থেকে আগত ব্যবসায়ীরা এর ফলে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রদর্শন করে। যেটা পরিণতিতে ব্যবসাকে গুটিকয়েক ব্যকতির হাতে তুলে দেয়। ফলে বাজার ধ্বংস হয়ে যায় এবং নানা ধরেণের প্রজাদের জীবিকা অর্জনের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে । কারণ প্রজাদের অধিকাংশই ক্রয়-বিক্রয়ের উপর নির্ভরশীল কাজেই বাজারের মন্দা অবস্থা তাদের জীবিকার দুরবস্থা ডেকে আনে এবং পরিণতিতে সম্রাটের রাজকোষের অবস্থাও মন্দ অথবা শোচনীয় হয়ে দীড়ায়। সরকার কর বৃদ্ধি করে কারণ সাম্রাজ্যের মধ্যাবস্থায় এটা থেকেই তার সমৃদ্ধি আসে এবং শেষের দিকে ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ধার্যকৃত অতিরিক্ত শুল্ক তার স্থান পূরণ করে, যেমন আমরা পূর্বে বর্ণনা করেছি (এই লেখার পর্ব -১ দেখুন)। এর পরিণামে সাম্রাজ্যের বিনাশ ও নাগরিক জীবনের ধ্বংস ঘনিয়ে আসে । অবশ্য এরূপ ক্ষতি ধীরে ধীরে সংঘটিত হয় এবং এ জন্য তা প্রায় বোঝাই যায় না।

এ পরিণতি মানুষের সম্পদের উপর অন্যায় আধিপত্য বিস্তারের ফলে দেখা দেয়। কিন্তু এ আধিপত্য যদি সরাসরি এবং মানুষের সম্পদ, পরিবার, জীবন, গোপনীয়তা ও সম্মানের উপর অন্যায় হস্তক্ষেপের ফলে বিস্তৃত হয়, তা হলে সেই মুহুর্তেই ক্রটি ও ক্ষতি বাস্তব হয়ে ওঠে। এর ফলে ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতায় যে গোলযোগ দেখা দেয়, তা সাম্রাজ্যের আশু বিনাশের কারণ হয়ে দীড়ায়।

এ সকল দোষক্রটির কারণেই ধর্মীয় বিধানগুলো অনুরূপ সকল বিষয়কেই নিষিদ্ধ করেছে। ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ শান্ত্রসম্মত হলেও অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ কুক্ষিগত করার বিষয়টি সর্বতোভাবে নিষিদ্ধ কেননা এর ফলে এমন সমস্ত অবিচার সংঘটিত হয়, যা পরিণামে মানুষের জীবিকা অর্জনের পথ রুদ্ধ করে এবং সভ্যতার বিনাশ ডেকে আনে।

ইবনে খালদুন লিখেছেন, পাঠক, জেনে রাখুন, এ সকল উৎপীড়ন একমাত্র সাগ্রাজ্য ও শাসকের অতিরিক্ত সম্পদ আহরণের লোভেই সংঘটিত হয়। কারণ তারা ভোগ-বিলাসে লিপ্ত হওয়ার ফলে তাদের ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং আইনানুগ স্বাভাবিক পদ্ধতিতে লভ্য আয়ের দ্বারা এ বিপুল ব্যয়ের সংকুলান হয় না। সুতরাং তারা নতুন নতুন ধারা ও খাত তৈরি করে তা দিয়ে অতিরিক্ত ব্যয়ের অনুপাতে রাজকোষের সঙ্গতি বাড়াতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু বিলাসব্যসন ক্রমশ বেড়ে চলে এবং সেই অনুপাতে খরচের মাত্রাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। কাজেই জনগণের সম্পদ কুক্ষিগত করার প্রয়োজনও তীব্র হয়ে ওঠে। এভাবে সাম্রাজ্যের কাঠামোগত ও নৈতিক বিন্যাস মুছে শিথিল হয়ে ক্রমশ সীমা অতিক্রম করে এবং এক সময়ে তার নিদর্শনাদি মুছে ফেলার জন্য নতুন কোনো শক্তিকে বিজয়ী করে তোলে ।

বিজ্ঞ পরিকল্পনামন্ত্রী যেটাকে "উদীয়মান" অর্থনীতির সমস্যা বলেছেন এবং অর্থনীতি 'বুড়ো' হলে স্থিতিশীল হবে বলে বলেছেন, ইবনে খালদুন সেটাকে উল্টো বলেছেন। ইবনে খালদুন বলেছেন সমস্যাটা শাসন পুরোনো হয় গেলে উদ্ভুত হয়, শুরুর দিকে শাসক থাকে দায়িত্বশীল, জনহিতৈষী ও উদ্দিপনায় ভরপুর, পরবর্তীতে যারা ধ্বংসাত্বক সমাজবিরোধী উৎপীড়কে পরিণত হয় যাদের রাজকোষে অনেক অর্থ দরকার। ইবনে খালদুন আরো বলেছেন এমন পরিস্থিত শাসকদের দায় না নেবার সংস্কৃতি থেকে সৃষ্টি হয় পরিকল্পনামন্ত্রীর বক্তব্য যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ যে তিনি সিন্ডিকেট দেখতে পাচ্ছেন না এবং দায়টাকে "উদীয়মান" অর্থনীতির ধর্মের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। ইবনে খালদুন আরো বলেছেন যে এর ফলে সমাজ অর্থনীতি ধ্বংস হবে (মানে দেশ শ্রীলংকা হবে) সেটাও বলেছেন এবং এটাও বলেছেন অর্থনীতি যত বড় হবে, এটা তত ধীরে ঘটবে এভাবে যে বোঝাই যাবে না। পরবর্তিতে এই ধ্বংস ছোট অর্থনীতি যত সহজে কাটিয়ে উঠবে, বৃহৎ অর্থনীতির জন্য সেটা ততই কঠিন হবে।

JadeWits Technologies Limited
সর্বশেষপঠিতনির্বাচিত

আমরা আমাদের সেবা উন্নত করতে কুকি ব্যবহার করি। আমাদের কুকি নীতির শর্তাবলী জানার জন্য অনুগ্রহ করে এখানে ক্লিক করুন। কুকি ব্যবহারের জন্য আপনি সম্মত হলে, 'সম্মতি দিন' বাটনে ক্লিক করুন।