EN
আরও পড়ুন
প্রকৃতি ও সুরক্ষা
বিজ্ঞানের উপনিবেশবাদ ও তার দেশী তাবেদারেরা -২
প্রকৃতি ও সুরক্ষা
বিজ্ঞানের উপনিবেশবাদ ও তার দেশী তাবেদারেরা -১
ধর্ম ও দর্শন
শহুরে শিক্ষিত দালালদের শক্তিশালী করার কৌশল
ধর্ম ও দর্শন
JadeWits Technologies Limited
তারুণ্য ও উন্নয়ন

"তোমার যেখানে সীমাবদ্ধতা, সেখানেই তোমার শক্তি" -গুস্তভ ইয়ুং

মেলানি ক্লায়েন: প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা বা স্বামী সন্তানের দায় যাকে ঠেকাতে পারেনি বিশ্ব সেরা মনোবিদ হতে

বাবা ছিলেন ভিয়েনায় একজন ডেন্টাল সার্জন। তাই ১৬ বছরের মেয়ে মেলানির স্বপ্ন ছিল সে ডাক্তার হবে। চার ভাই বোনের মধ্যে যে ছিল সবচেয়ে ছোট। ঐ বছরই এনট্রান্স পাশ করে খুব খুব মনোযোগ দিয়ে সে পড়াশোনা শুরু করল। তার যখন সতেরো বছর বয়স তখন আর্থার ক্লেইন নামে তার এক কাজিনের সাথে তার পরিচয় হল যে ছিল তার চেয়ে চার বছরের বড় যে জুরিখে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিল। প্রথম দেখাতেই আর্থার তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল এবং মেলানি তাকে গ্রহণ করল তার ফিঁয়াসে (বাগদত্তা) হিসাবে।

পরের বছর মেলানির বাবার মৃত্যু হয় যখন তাঁর বয়স ৭২। এর দুই বছর পর মেলানির খুব কাছের বড় ভাই মারা যায় মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে। জন্ম থেকেই যার হার্টে সমস্যা ছিল। মেলনি মানসিক ভাবে খুবই আঘাত পায় বাবা মারা যাবার পরপরই প্রিয় ভাইয়ের মৃত্যুতে।

বাবা ও ভাইয়ের মৃত্যুতে ভেঙে পড়া মেলানি তখন বিয়ে করে ফেলে আর্থারকে যখন তার বয়স একুশ। দ্রুতই পেটে বাচ্চা আসে তার। লাটে ওঠে তার ডাক্তার হবার স্বপ্ন। বিয়ে এবং সন্তান জন্মের পর মেলানি উদ্বেগ আর বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়, ডুবে যেতে থাকে হতাশায়। তাদের বিবাহ দ্রুতই অসুখি দাম্পত্যে রূপ লাভ করে। কিন্তু একে একে মেলানি আরও দুটো সন্তানের মাতা হয়। তৃতীয় সন্তান আসার আগে মোলানির বিষন্নতা মারাত্মক বাড়তে থাকে।

এই সময় সান্ডর ফেরেন্সি নামে এক সাইকোএনালিস্টের কাছে সে সাইকোএনালিসিস সেশন শুরু করে উদ্বেগ আর বিষন্নতার চিকিৎসা হিসাবে। জীবনে প্রথমবারের মত মেলানি তার মনের কথা ও বদ্ধ আবেগ কারও কাছে প্রকাশ করতে পারে যে কিনা যথেষ্ট বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি এবং যে অতি মনোযোগ দিয়ে সেগুলো শুনছে এ বুঝতে পারছে। ফেরেন্সির সাথে তার প্রথম সেশনটাই তার জীবনে প্রশান্তির এক জলচ্ছাস বহিয়ে দেয়।

চিকিৎসা চলার সময়ই ফ্রয়েডের ‘স্বপ্নের ব্যাখ্যা’ (Die Traumdeutung) বইটি পড়ে অভিভূত হয়। যখন তার সাইকোএনালিসিসের মাধ্যমে চিকিৎসা চলছে, তখনই সে সিদ্ধান্ত নেয় সাইকোএনালিসিস শেখার। তখন সে উদ্বেগ আর বিষন্নতায় ভোগা এক স্কুল পাশ নারী যে তিন বাচ্চার মা, যার কোন ব্যাচেলর ডিগ্রি নাই এবং যার বয়স আটত্রিশ।

তখন সে ফ্রয়েড ও অন্যান্যদের সাইকোএনালিসিস সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করে। তখন সিগুমন্ড ফয়েড জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। একের পর এক তার সাড়া জাগানো গবেষণাপত্র বের হচ্ছে। ফ্রয়েড সাইকোএনালিসিস এর পিতা হলেও শিশুদের সাইকো এনালিসিস করা যায় বলে তিনি মনে করতেন না। তিনি ভাবতেন শিশুদের মস্তিস্ক অপরিণত তাই সাইকোএনালিসিস সম্ভব নয়। 

মেলানি তার পাঁচ বছর বয়সি ছেলে এরিখকে পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। ফ্রয়েড সাইকোএনালিসিস করতেন প্রধানতঃ পেশেন্টের স্বপ্নকে নির্ভর করে তার অবচেতনকে বিশ্লেষণ করে। শিশুদের নিয়ে সেটা করা সম্ভব হতো না। প্রথম বারের মত মেলানি আবিষ্কার করলেন খেলাটাই শিশুদের জন্য স্বপ্ন। শিশুদের খেলা এবং খেলার সময় তাদের আবেগের প্রকাশ ও প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে তিনি প্রথম গবেষণাপত্র লিখলেন যা ছিল তার ছয় বছরের ছেলে এরিখের সাইকোএনালিসিস। 

শিশুদের প্রথম সাইকোএনালিসিস ও তার উৎকর্ষতা দেখে হাঙ্গেেরিয়ান সাইকোএনালিটিক সোসাইটি তাকে তাদের সদস্য করে নেয় সাথে সাথে। তার গবেষণা কক্ষে থাকত বাচ্চাদের খেলনা গাড়ি, ঘোড়া, হাঁড়ি, পতিল, পুতুল এই সবে পরিপূর্ণ। 

বাচ্চাদের সাইকোএনালিসিস করলেও তার তত্ত্বগুলো আজ প্রায় শতবর্ষ পরে মহা মুল্যবান মানুষের চরিত্র ও আচরণ বোঝার জন্য। আমার অনেক লেখাতেই মেলানি ক্লেইনের অবজেক্ট রিলেশন তত্ত্ব নিয়ে লিখেছি যেটা আমাদের অপরিণত বাঙালী চরিত্রের অনেক কিছুর ব্যাখ্যা দিতে পারে। 

পরবর্তিতে বার্লিন সাইকোএনালিটিক সোসাইটি তাকে সদস্য পদ দেয় ও মেলানি বার্লিনে শিশুদের চিকিৎসা ও গবেষণা শুরু করেন। 

কিন্তু তার অবজেক্ট রিলেশন তত্ত্ব ফয়েডের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। ফ্রয়েডিয়ানরা যেখানে ইগো ও ড্রাইভ দিয়ে আচরণকে ব্যাখ্যা করে চায়, অবজেক্ট রিলেশন তত্ত্ব সেটা থেকে বেরিয়ে আসে। এর ফলে তার প্রতি বিরুদ্ধতা, শত্রুতা, তাকে অবমাননা উপহাস, পরিহাস বেড়ে যায়। তখন লন্ডন সাইকোএনালিটিক সোসাইটি তাকে আমন্ত্রণ জানায় ও মেলানি লন্ডনে চলে যান।

অবজেক্ট রিলেশন তত্ত্ব ছাড়াও মেলানি ক্লেইনের প্যারানয়েড-সিজয়েড অবস্থা, শিশু ওডিপাস কমপ্লেক্স, প্রজেক্টিভ আইডেন্টিফিকেশন, প্যাথলজিক্যাল অর্গ্যানাইজেশন, রিপারেশন, ইন্টর্নাল অবজেক্ট, সিম্বল ফর্মেশন, আনকনশাস ফ্যানটাসি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সব তত্ত্ব বা ধারণা আজ মনোবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি যার উপরে দাঁড়িয়ে আছে আরও বহু তাত্ত্বিকের কাজ।

আমি মনে করি আমাদের বাঙালী চরিত্রের অনেক নেতিবাচক বৈশিষ্ট আসলে অপরিণত মানসিকতা যা সঠিকভাবে পরিণতি লাভ করে না। সেগুলো আসলে মেলানি ক্লায়েনের অবজেক্ট রিলেশন তত্ত্ব, ক্লায়েনিয় প্যারানয়েড-সিজয়েড অবস্থা, শিশু ওডিপাস কমপ্লেক্স, প্রজেক্টিভ আইডেন্টিফিকেশন, রিপারেশন, সিম্বল ফর্মেশন, আনকনশাস ফ্যানটাসি এসব দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।

আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষা, গবেষনা এসবের কথা উঠলেই আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সময়, একাডেমিক স্কোর, সুযোগ, অর্থ, সাপোর্ট এসবের কথা বলে থাকেন। প্রকৃত গবেষণা সব সময় নিজের জীবনের সমস্যা ও সেটা থেকে পরিত্রাণের পথে উৎসাহ নিয়ে জ্ঞান অর্জন ও পর্যবেক্ষণ থেকেই হয়ে থাকে যার মূল হল মৌলিক চিন্তা বা অরিজিনাল থিংকিং। যার জন্য থাকতে হয় আভ্যন্তরিণ অন্বেষণের তাগিদ বা ইনার কোয়েস্ট। 

মেলানি ক্লায়েনের জীবন কাহিনী বলে দেয় ইনার কোয়েস্ট থাকলে বাকি কোন বাধাই বাধা নয়। গুস্তভ ইয়ুং বলেছেন "তোমার যেখানে সীমাবদ্ধতা, সেখানেই তোমার শক্তি"। মেলানি ক্লায়েনের তত্ত্বগুলো এও বলে দেয় কেন আমাদের তথাকথিত 'মেধাবীদের' মধ্যে ইনার কোয়েস্ট নেই।

JadeWits Technologies Limited
সর্বশেষপঠিতনির্বাচিত

আমরা আমাদের সেবা উন্নত করতে কুকি ব্যবহার করি। আমাদের কুকি নীতির শর্তাবলী জানার জন্য অনুগ্রহ করে এখানে ক্লিক করুন। কুকি ব্যবহারের জন্য আপনি সম্মত হলে, 'সম্মতি দিন' বাটনে ক্লিক করুন।