১৭ কোটি লোকের ভাগ্য নিয়ে খেলছে অপরিণত চিন্তার কিছু উন্মত্ত যুবক। নিজেদের বয়সেরতো বটেই, বয়োজেষ্ঠ্যদের অসম্মান এবং নারীদের ও পথচারীদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেবার জন্য হেনস্তা করে চলেছে সাধারণ জনগণকে। পায়ে পিষ্ট করছে জাতীর ইতিহাস। দেশকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গৃহযুদ্ধের দ্বার প্রান্তে।
তাদের এই তথাকথিত বিপ্লবের নীল নকশা কাদের? দেশের মানুষদের না বিদেশের? তারা প্রথম থেকেই এটাকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ ভাবছে কেন? এত দ্রুত তারা সরকার পরিবর্তন বা রেজিম চেঞ্জের ধারণায় চলে কেন গেল? যদি সেটাই পরিকল্পনা থাকে তাহলে সেটা ঘোষণা দিয়ে তারা আন্দোলন শুরু করেনি কেন? গণ আন্দোলনতো সন্ত্রাসী কার্যক্রম নয় যে গোপন এজেন্ডা থাকবে। আমি রাস্তায় নামলে জেনে নামতে চাই যে চুড়ান্ত পরিকল্পনাটা কি। ঘটে যাওয়া গণ বিক্ষোভে মূল শক্তি কারা ছিল? কিশোর গ্যাং ও অপরাধী কারা জড়িত ছিল? তাদের সংখ্যা কত?
ভাড়াটে কর্মী কত ছিল? শোনা যাচ্ছে ৫০০ কোটি টাকার বাজেট ছিল। তাদের অর্থ সরবরাহ করেছে কারা। এর মধ্যেই একজন উপদেষ্টা বলেছেন পুলিশের গুলির চেয়ে নিষিদ্ধ অস্ত্রে মানুষ মারা গেছে বেশি। সেই অস্ত্র কোথা থেকে এল। সেই অস্ত্র চালিয়েছে কারা? উক্ত উপদেষ্টা বলেছেন এক হাজার মানুষ মারা গেছে এই ঘটনায়। এক হাজার মানুষ মারা যাবার ঘটনার পর পরই মাইক বাজিয়ে উন্মত্ত নৃত্য করে লুঙ্গি ড্যান্সের উৎসব তারা কিভাবে করে?
প্রাথমিক শক কাটানোর পর অর্থনীতির ধাক্কায় সজাগ হবার পর এসব প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ মানুষের মনে। যারা পরিস্থিতির আবেগে তাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন তারা এখন দেখছেন ব্যবসা প্রায় বন্ধ। সমাজ অনিরাপত্তায় ছেয়ে গেছে। শিশুরা ভ্রষ্ট। সরকার বৈধ নয়। আয়নাঘর আগের মতই আছে। প্রশাসন ভঙ্গুর। সামনে অন্ধকার।
যাই হোক উপরের বিষয়গুলো নিয়ে পরবর্তিতে আলোচনা করা যাবে। এখন আমরা একটু বোঝার চেষ্টা করি এই আন্দোলনে জড়িতদের যে বয়স, সেই বয়সের আধুনিক ছেলেমেয়েদের মনোজগত এবং আচরণগত ও চিন্তাপ্রক্রিয়াগত চরিত্রগুলো কি। সেই আচরণগুলো আন্দোলনকারীদের চরিত্রে কতটুকু প্রকাশ হয়েছে সেই বিচার পাঠকদের উপর ছেড়ে দিলাম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ১০ বছর এবং ১৯ বছর বয়সের মাঝামাঝি সময়টাকে কৈশোর বলে। এর যে কোন সময়ে বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হতে পারে। এটা মূলত কৈশোর ও যৌবনের মধ্যবর্তী পর্যায়। এতদিন উনিশ বছর বয়সকেই বয়ঃসন্ধিকালের শেষ সীমা বলে মনে করা হতো। কিন্তু নতুন প্রজন্মগুলোর আচরণ নিয়ে করা গবেষণাগুলো বলছে আগে যা ভাবা হতো তার চেয়ে বয়ঃসন্ধিকালের সমাপ্তি হচ্ছে আসলে তার চেয়ে অনেক বেশি বয়সে। দশ বছর বয়সে শুরু হয়ে তা চলছে ২৪ বছর পর্যন্ত। এর অর্থ বয়ঃসন্ধিকালের আচরণ ও চিন্তা প্রক্রিয়া এখন ২৪ বছরের যুবকও প্রদর্শন করছে।
“বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের ক্ষেত্রে, তারা যে পরিবেশ-পরিস্থিতিতে বেশি সময় কাটায়, সেই স্থানের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বয়সে আবেগ, পারিবারিক নির্ভরতা, নিরাপদ ও সম্পূর্ণ আত্মকেন্দ্রীক জগৎ থেকে বের হয়ে এসে তারা ক্রমেই বাইরের জগতের সাথে একাকী মিথস্ক্রিয়া করতে থাকে এবং তাদের ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে তাদের আবেগ, চিন্তাপ্রক্রিয়ার দক্ষতা ও বিচার বোধ প্রতিমুহূর্তে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। তাদের পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা যত স্বাভাবিক ও যুক্তিসংগত হবে, ততই তারা নিজেদের আত্মবিশ্বাস ও দক্ষতার সাথে দুনিয়ার সাথে সংযুক্ত করতে পারবে এবং পরিশেষে উন্নতি ও পরিবর্তনের দায়িত্ব নিতে শিখবে।
শিশু যখন গড়ে ওঠার বিভিন্ন ধাপে মস্তিস্কের যে অংশটি প্রথম ব্যবহার করতে শেখে, সেটার অতি প্রয়োগে আনন্দ পায়। যখন সে প্রথম হাত-পা নাড়তে শেখে, তখন সেগুলো করেই সে আনন্দ পায় এবং সর্বদা সেটা করতে থাকে। এরপর আর একটু বড় হলে, যখন সে তার আবেগের নিয়ন্ত্রণ নিতে শেখে, তখন সেটির যথেষ্ট ব্যবহার করে। একটি নতুন জামা বা প্রিয় খাবারের জন্য কখন, কার কাছে, কিভাবে বায়না ধরতে হবে সেটা সে দ্রুতই শিখে নেয়। সাত বছর বয়সের পর থেকে ক্রমেই তার নিওকর্টেক্স সক্রিয় হতে থাকে এবং বয়ঃসন্ধিকালে সেটি পূর্নতা পায়। বয়ঃসন্ধিকালে তাই তার নতুন পাওয়া ‘যন্ত্রটি’ (যেটা ভাষার ব্যবহার, বিমূর্ত চিন্তা, পরিকল্পনা ইত্যাদিতে দক্ষ) সেটির অতি ব্যবহার শুরু করে। এর ফলে বয়ঃসন্ধিকালে শিশুর কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যেগুলো আমেরিকান শিশু মনোবিজ্ঞানী ডেভিড এলকাইন্ড ‘বয়ঃসন্ধিকালের ছয়টি অপরিণত চিন্তা’ হিসেবে নির্দেশ করেছেন।
এলকাইন্ডের বয়ঃসন্ধিকালের ছয়টি অপরিণত চিন্তা:
১. আদর্শবাদ ও অতি সমালোচনার মানসিকতা (Idealism and Criticalness):
শিশু থেকে বড় গতে হতে বয়ঃসন্ধিরা মনে মনে একটি আদর্শ পৃথিবী কল্পনা করে। কিন্তু বাস্তব দুনিয়ার জটিলতা ও রাজনীতি বুঝতে না পেরে জীবনের বাস্তবতার সাথে মিথস্ক্রিয়ায় পৃথিবীটাকে তারা গোলমেলে ও বিপজ্জনক বলে মনে করে। স্তব দুনিয়ার জটিলতাকে তারা বড়দের দ্বারা পরিচালিত পৃথিবীর ব্যর্থতা বলে ধরে নেয় এবং এর জন্য বড়দের ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠিতদের তারা দায়ী করে থাকে।
২. তর্কপ্রবণতা (Argumentativeness):
বয়ঃসন্ধিরা সরল যুক্তিনির্ভর চিন্তা করে। যেহেতু প্রথমবারের মতো তারা তাদের যুক্তিশীল মস্তিস্ককে ব্যবহার করতে শেখে, তারা বোঝে না কোথায় যুক্তি ছেড়ে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান আরও বেশি ফলদায়ক। অতি জটিল বিষয়ে যে সরল যুক্তি যথেষ্ট নয়, এই অভিজ্ঞতা তাদের নেই, তাই তারা কোনভাবেই নিজে হেরে যাবে না এই ইগো থেকে তর্কপ্রবণ হয়ে থাকে।
৩. সিদ্ধান্তহীনতা (Indecisiveness):
সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে নানা বিকল্প পথ তাদের কাছে সরল যুক্তিতে গ্রাহ্য হয়। অভিজ্ঞতার অভাবে তারা যুক্তির জালে আটকে পড়ে; কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাবে চিন্তাগত বোধ (কগনিটিভ সেন্স) তাদের সাহায্য করতে পারে না। তাই তারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে।
৪. আপাত কপটতা (Apparent Hypocrisy):
বয়ঃসন্ধীরা মনে মনে একটি আদর্শ পৃথিবী কল্পনা করে। কিন্তু তাদের নিজেদের জীবন তখনও এতটাই আবেগ ও প্রবৃত্তিনির্ভর যে সেই আদর্শ নিজের জন্য প্রয়োগ করতে তারা একেবারেই অক্ষম। একদিকে তারা অতি আদর্শবাদী, কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে তারা অসৎ, লোভী, স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, আইন ভঙ্গকারী এবং নিজের আদর্শ নিজের জন্য প্রয়োগ করতে অক্ষম। এটিই তাদের আপাত কপটতা।
৫. অতি আত্ম-চেতনা (Self-Consciousness):
বয়ঃসন্ধিরা মনে করে জগতের সবাই তাকে দেখছে বা তার কথা ভাবছে। নিজের সম্পর্কে তার এমন ধারণা যে সে যা ভাবে বা করে, সেগুলো মানুষ লক্ষ্য করে, মূল্যায়ন করে এবং সেটি অন্যদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু। আসলে, যেটি একদমই সত্য নয়।
৬. অসাধারণত্ব ও অভেদ্যতা (Specialness and Invulnerability):
একজন বয়ঃসন্ধি মনে করে বিপদ অন্যদের হয়, সে নিজে সব রকম বিপদের ঊর্ধ্বে। সে নিজেকে অবচেতনে সুপারম্যান বা ওয়ান্ডারওম্যানের মতো সকল বিপদ ও পরিণতির উর্ধ্বে মনে করে। যে কাজ করলে শত ভাগ বিপদের আশঙ্কা, তবু সে মনে করে সে পার পেয়ে যাবে।
বয়ঃসন্ধিকালীন এসব ধারণা থেকে তৈরি হয় কল্পিত দর্শকের ধারণা (Imaginary Audience) এবং ব্যক্তিগত উপকথা (Personal fable)।
কল্পিত দর্শকের ধারণা হলো, সে মনে করে তার জীবন কোনো মূল্যবান মঞ্চের এক প্রদর্শনী এবং প্রচুর দর্শক সেটি দেখছে, যদিও বাস্তবে তেমন কেউ-ই তাতে উৎসাহী নয়; তাই তার মনে এই দর্শকরা কল্পিত। ব্যক্তিগত উপকথা হচ্ছে, ‘মঞ্চে’ প্রদর্শিত তার জীবন যেন একটি উপকথা, যার নায়ক বা নায়িকা সে নিজেই। এমন পৃথিবীতেই তার বাস।
এলকাইন্ডের উপরে উল্লেখিত বয়ঃসন্ধিকালীন চিন্তাগুলো তার পূর্ববর্তী মনোবিজ্ঞানীদের ধারণাকে সমর্থন করে এবং অনেকগুলো পরবর্তী গবেষণায়ও প্রমাণিত হয়েছে। এতে দেখা যায়, বয়ঃসন্ধিকালীন চিন্তাগুলো যদি শিশুর শারীরিক, মানসিক, পরিবেশগত বা আচরণগত কোনো কারণে অসমাধিত থেকে যায়, বা বয়ঃসন্ধি পার হয়ে গেলেও কোনো কোনো চিন্তাধারা থেকে যায়, তাহলে বিভিন্ন পুশ ও পুল ফ্যাক্টরের কারণে তারা কৈশোরের অপরাধমূলক বা আত্মহানিকর কর্মকান্ডে জড়িয়ে যেতে পারে”।
*উপরে কোট করা অংশটুকু আমার ২০১৮ সালে আমার লেখা একটি বই থেকে নেওয়া।