গত পর্বে আমরা দেখেছি যে পরাশক্তিগুলোর জন্য যুদ্ধ কত ভয়ানক, সেগুলো কত বৃহৎ পরিসরের এবং কত দীর্ঘ পরিকল্পনায় হয়ে থাকে। গত ৮৫ বছরে পরাশক্তিগুলোর কয়েক'শ গুন শক্তিশালী হয়েছে এবং সমরাস্ত্র ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের ফলে পরবর্তী যুদ্ধ নিয়ে পরাশক্তিগুলোও ভীত। এই ভীতি তাদের আরো কৌশলী করছে এবং দীর্ঘ সময় নিয়ে তারা সম্ভাব্য শত্রুর নাজুক অবস্থাগুলোকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যত যুদ্ধে নিজেদের এগিয়ে রাখতে চাইছে। খনিজ তেল কয়লা, পারমাণবিক বিদ্যুৎ বা নবায়নযোগ্য শক্তি সবগুলোই আধুনিক দুনিয়ার শিল্প উৎপাদন ও ব্যবহার্য জ্বালানি হলেও আধুনিক যুদ্ধ খনিজ তেল ছাড়া চলে না। যুদ্ধের বিমান, জাহাজ, সামরিক যানবাহন সবই খনিজ তেল ছাড়া অসহায়। যুদ্ধের সময় খনিজ তেলের সরবরাহ চালু রাখা তাই একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তার বিষয়। এর সাথে শত্রুর খনিজ তেলের সরবরাহ বন্ধ করা বা সেটাকে অনিরাপদ করে তোলা একটি গুরুত্বপূর্ণ সমর কৌশল। এর জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি ও বিনিয়োগও লাগতে পারে।
চীন ২০১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে বিশ্বের বৃহত্তম অপরিশোধিত তেল আমদানিকারক হয়ে ওঠে। এবং এই চাহিদার ৭০% প্রধানত পশ্চিম এশিয়া অঞ্চল থেকে আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। আগামী ২০ বছরে চীনের তেল আমদানি ১৫% বৃদ্ধির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। তাই শান্তিকালীন এবং যুদ্ধাবস্থা উভয় সময়ে চীনের জ্বালানি নিরাপত্তা এবং বিশেষ করে তেল সরবরাহের নৌ পথ বা পাইপ লাইনের নিরাপত্তা চীনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পশ্চিম এশিয়া থেকে চীনে তেল পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত সামুদ্রিক রুট বরাবর অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ সরু প্যাসেজ বা চোক পয়েন্ট রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হল মালাক্কা প্রণালী, যে প্রণালী দিয়ে চীনের জ্বালানি আমদানির ৮০% পরিবাহিত হয়। মালাক্কা প্রণালী, বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিপিং লেন যা সুমাত্রা দ্বীপ এবং মালয় উপদ্বীপের মধ্যে অবস্থিত। এটি একটি সংকীর্ণ কিন্তু সোজা জলপথ যা ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরকে সংযুক্ত করে। চীন সরকার পূর্বে উদ্বিগ্ন ছিল যে অন্যান্য বড় রাষ্ট্রগুলো এই প্রণালীতে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করতে পারে কারণ তারা চীনের মতোই এটির উপর নির্ভরশীল। যে শক্তি মালাক্কা প্রণালী নিয়ন্ত্রণ করবে তারা পরোক্ষভাবে চীনা অর্থনীতির প্রধান ধমণী নিয়ন্ত্রণ করবে।
চীনকে নিয়ন্ত্রণের জন্য তাই চীনকে যারা প্রধান প্রতিদ্বন্দী বলে মনে করে তারা মালাক্কা প্রণালী এলাকার নিকটস্থ দেশগুলোতে নিজেদের সামরিক ঘাটি তৈরি করবে এবং সেই সব দেশে নিজেদের পছন্দমত সরকার বসাতে চাইবে এটা আর কারও জন্য সত্য না হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সত্য। সেই কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এই এলাকার বেশ কিছু দেশ এই অঞ্চলে একটি বৃহত্তর নিরাপত্তা-সম্পর্কে জড়িত চীন সবসময় যার কঠোর সমালোচনা করে আসছে। এইসব দেশগুলো হচ্ছে জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের থাইল্যান্ড ইত্যাদি যার মধ্যে অনেক দেশেই মার্কিন সামরিক ঘাটি রয়েছে। এই এলাকায় মিত্রদের হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান সামরিক উপস্থিতি চীনের অর্থনীতির লাইফ লাইন ও যুদ্ধকালীন জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য তাই সরাসরি হুমকি।
মালাক্কা প্রণালী বাংলাদেশ থেকে অনেক দুরে এমনকি আমাদের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ থেকেও। তাহলে এই সমীকরণে আমরা কেন? ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জন্য নেপাল ও বাংলাদেশের নিকটস্থ সীমানায় ‘মুরগির গলা’ বা ‘চিকেন নেক’ এলাকাটা ভারতের জন্য একটি বড় সমস্যা। যে কোন শক্তি যদি এই সামান্য অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় তাহলে ভারত ব্যাপক সমস্যায় পড়ে যাবে। চীনের জন্য মালাক্কা প্রণালী তেমনই। ভারত যেমন তার এই ‘মুরগির গলা’ সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজছে, চীনও তাই হন্যে হয়ে মালাক্কা প্রণালীর বিকল্প পথ খুঁজছে। মালাক্কা প্রণালীর বিকল্প খুঁজতে গেলে চীনকে আরো উত্তরে উঠে আসতে হবে।
যার একটি হল ভারত মহাসাগরের দিকে থাইল্যান্ডের ভূমি ব্যবহার করে তাক পথ বের করতে হবে। থাইল্যান্ডের ফুকেটের কাছে একটি খাল বা ক্যানাল তৈরি করা যা ক্রা ইস্তমাস খাল নামে পরিচিত। এটি শত শত বছর থেকে ভাবা হচ্ছে এবং নানা জটিলতায় এটি বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কম। এর সাথে থাইল্যান্ডে মার্কিন উপস্থিতি এবং মালাক্কা প্রণালী এলাকা থেকে এটি বেশি দুরে নয় বলে এটি চীনের সমস্যার সমাধান তেমন একটা করবে না।
চীনের জন্য মালাক্কা প্রণালীর আর একটি বিকল্প পথ হচ্ছে চীন পাকিস্তান ইকনমিক করিডোর (CPEC) এর গাওদর-জিনজিয়াং পাইপলাইন। বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন পাথুরে ভূখণ্ডের জন্য প্রযুক্তিগতভাবে এটি সহজ নয় তাই এটির পরিকল্পনা লজিস্টিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এর সাথে চীনের জিনজিয়াং অঞ্চল এবং পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও আর এক সমস্যা।
এখন বাকি থাকে আর দুটি পথ যে দুটোতেই বাংলাদেশ জড়িত। যার একটি হল চীন মিয়ানমার ইকনমিক করিডোর (CMEC) এর মিয়ানমার-ইউনান পাইপলাইন। এর জন্যই মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ তৈরি করা হয়েছে কিয়াউকপিউ সমুদ্র বন্দর। মায়ানমার-ইয়ুনান পাইপলাইনটি মিয়ানমারের বন্দর হয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে চীনে তেল পরিবহনের জন্যও ব্যবহার করা হবে। চীন এর সাথে চট্টগ্রাম বন্দরকে যুক্ত করার জন্য এর মধ্যেই উন্নয়ন প্রস্তাব দিয়েছে। সোনাদিয়া বন্দর তৈরির ইচ্ছাও তারা একই কারণে করেছিল। রাখাইনের কিয়াউকপিউ বন্দর নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমাদের সেন্টমার্টিন হচ্ছে আদর্শ স্থান।
এই কারণেই রাখাইন রাজ্যে গণহত্যা চালানো হয়েছে এবং রোহিংগা সঙ্কট তৈরি করা হয়েছে এলাকাটিকে নিরাপত্তাহীন করার জন্য। রোহিংগা সঙ্কট তৈরি করার জন্য আমেরিকার সিআইএ ও পাকিস্তানের আইএসআই সরাসরি জড়িত। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ফেসবুকও রাখাইনে গণহত্যা চালানোর জন্য মিয়ানমারের সামরিক কর্মকর্তাদের নিজেদের পলিসি ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন করে সহায়তা করেছে বলে জাতিসংঘের রিপোর্টে উল্লিখিত আছে। এই এলাকাতে মার্কিন নিয়ন্ত্রণের জন্যই পাশাপাশি দুই দেশের দুজনকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে ক্ষমতায় বসানোর জন্য একই কারণে।
চীনের জন্য মালাক্কা প্রণালীর আর একটি বিকল্প পথ হল মিয়ানমার ও বাংলাদেশ হয়ে ভারতের সাথে সংযোগ। এই অঞ্চলে মার্কিন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলে ভারত তার পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হবে। সেই কারণে ভারত চায় বাংলাদেশ চীন ভারত মিয়ানমার (BCIM) ইকনমিক করিডোরের বাস্তবায়ন। আমাদের পদ্মা সেতু এই সংযোগের অংশ। যার উপর দিয়ে ভারত করিডোর চেয়েছিল। যেটা আমেরিকা চায় না। সেই কারণেই ড: ইউনুস এর বিরোধী ছিলেন। সেই কারণেই বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল করে।