লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক। পাহাড় জঙ্গল ডিঙ্গিয়ে প্রায় দুই ঘন্টা যাবত অনুসরণ করছি আমরা পাঁচ জনের একটি উল্লুক পরিবারকে। গাছের মগডালে থাকা পরিবারটিতে মা, বাবা, দুটি মেয়ে ও একটি ছেলে। উল্লুকরা আমাদের মতই তরুণ বয়েস জুটি বাঁধে এবং পরিবার তৈরী করে একত্রে বাস করে তাদের ছেলে মেয়ে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত। এর পর মা বাবাই নব যৌবনপ্রাপ্ত ছেলে মেয়েদের জন্য পাত্র পাত্রী খুঁজে নতুন জুটি তৈরী করে দেয়। একদমই আমাদের অ্যারেঞ্জড ম্যারেজের মত।
আমার সাথে একজন তরুণী উত্তর ইউরোপীয় বান্ধবী যে অক্সফোর্ড ব্রুকস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণা করতে এসেছে উল্লুকের উপরে। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে আমরা এই উল্লুক পরিবারটিকে অনুসরণ করছি। জুন মাসের অসহ্য গরম। পুরো জঙ্গলে জমা রাতের শিশির সকালের সূর্যের তাপে জলীয় বাষ্পে পরিণত হয়েছে কিন্তু জঙ্গল ছেড়ে যায়নি। তার ফলে মাপলে হয়ত আপেক্ষিক আদ্রতা একশ’র কাছাকাছি হবে। কয়েক মিনিটেই ঘামে ভিজে আমাদের পোশাক আমাদের গায়ে লেপ্টে গেছে।
উল্লুকরা পাখি ছাড়া গাছে বাস করা প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত চলতে পারে। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের পাহাড় জঙ্গল ডিঙ্গিয়ে তাদের অনুসরণ করতে হচ্ছে। এর মধ্যেই দুবার বৃষ্টি নেমেছে। খাড়া পাহাড়ের ঢালগুলো পিচ্ছিল। আমার সঙ্গী অত্যন্ত ফিট। যে সব মেয়েরা টেনিস খেলে বা ঘোড়ায় চড়ে অভ্যস্ত, তাদের পাগুলো শুধু আকর্ষণীয়ই হয় না শক্তিশালীও হয়। কিন্তু ঘোড়ায় চড়ে অভ্যস্ত মেয়েটার পাগুলোর চেয়েও শক্তিশালী তার মন। সে অত্যন্ত ফোকাসড ও ডিটারমাইন্ড।
অপরদিকে আমার মনে অনেক দ্বিধা ও চিন্তা। আমার হাতে প্রায় দশ লক্ষ টাকা দামের ক্যামেরা ও লেন্স। শুধু মূল্যবান দেখে নয়, যে কোন ফটোগ্রাফারের কাছে তার ক্যামেরার নিরাপত্তা একটা আধ্যাত্মিক বিষয়। ক্যামেরাকে শিশুর মত আগলে রাখতে হয়। এর সাথে আমি জানি এই জঙ্গলে অনেক বিষধর সাপ আছে। আছে পা পিছলে পড়ে যাবার ভয়। এই চেনা জঙ্গলেও ট্রেইলের বাইরে এমন কোন দুর্ঘটনা ঘটলে সেটা জীবন হানির কারণ হতে পারে যেখানে জঙ্গলের ভেতরে মোবাইল নেটওয়ার্ক থাকে না। পুরো পরিস্থিতিটার ঝুঁকি ও তার জন্য রচিত নানা সাবধানতা ও কৌশল আমার মগজের অর্ধেক দখল করে রেখেছে। আমার সঙ্গিনীর সে সব দিকে হুঁশ নেই। আমি আছি তার সাথে তাই সে নিশ্চিন্ত। তার উল্লুক দল আর তার পানিরোধী নোটবই আর কলম ছাড়া আর কিছু ভাবছে না।
প্রথম পাহাড় থেকে নেমে একটি হাঁটু পানির ছড়া পার হয়ে পরিবারটির পিছু নিয়েছি। সামনে আর একটি পাহাড়ের চুড়ার একটি চাপালিশ গাছে ওরা এখন বসেছে আর পাকা চাপালিশ খাওয়া শুরু করেছে। ওদের প্রাতরাশ চলছে এখন। আমরা এই পাহাড়টির উপরও উঠে পড়লাম বেশ কষ্ট করে ঝুঁকি নিয়ে। একটু সমতল একটু শুকনো যায়গা পেয়ে আমরা সেখানে বসলাম। মেয়েটা বাইনোকুলার আর তার পানিরোধী নোটবই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল, আর আমি ক্যামেরা নিয়ে।
হঠাৎ মেয়েটা চীৎকার দিয়ে লাফ দিয়ে উঠল – জোঁক। আমার কাছে এসে ঘুরে দাঁড়াল, বলল দেখ তো পেছনে আরও আছে কি না? আমি তার ট্রাউজার থেকে টি-শার্ট থেকে গলা কাঁধ থেকে গোটা দশেক জোঁক ছাড়ালাম। এবার আমার পেছনে গিয়ে সে গোটা বিশেক আমার শরীর থেকে ছাড়াল। যে যায়গাটিকে আমরা শুকনো ভেবে বসেছিলাম, পানি থেকে বাঁচতে জোঁকেরাও সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল একই কারণে।
আমরা জোঁকের স্থানটা থেকে একটু সরে গিয়ে আবার কাজে মন দিলাম। যত কঠিন পরিস্থিতিই হোক না কেন যে কোন উল্লুক দলের দিকে লেন্স ফোকাস করে যখন আমি তাদের দিকে তাকাই, আমি যেন আঠার মিলিয়ন বছর আগে চলে যাই। আঠার মিলিয়ন বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষ আর উল্লুকদের পূর্বপুরুষেরা একই ছিল। আমার মনে হতে থাকে আমি যেন আমাদের পূর্বপুরুষদের দেখছি। আমাদের সাথে ওদের এত মিল, চোখের ভাষা, মুখের অভিব্যক্তি, বাচ্চাদের খেলাধুলা, মজা করা, একজন আর এক জনকে আদর করা, বকা দেওয়া, শাসন করা এমনকি যৌন নিষেধাজ্ঞা পর্যন্ত একই রকম যেখানে কিশোর কিশোরী ভাইবোন যাদের বয়ঃসন্ধিকাল পেরিয়েছে হয়েছে তাদের এক গাছে বসা নিষেধ।
এই উল্লুকদের দেখতে দেখতে একটি বিষয় মনে হতে থাকে যে এরা মানুষের মতই নাজুক। হালকা দেহ, শক্তিশালী দাঁত, নখ এমনকি আগ্রাসী আচরণও এদের নেই। তাহলে অন্য প্রাণীদের সাথে প্রতিযোগিতা করে এরা খাদ্য সংগ্রহ করে কিভাবে? এরা শত্রু মোকাবিলাই বা করে কিভাবে? এরা গাছের ফল ও পোকামাকড় খেয়ে থাকে তাই শিকার করার প্রশ্ন নাই। জঙ্গলের উচ্চতম তলে বা ক্যানোপিতে বাস করার ফলে এদের কোন শত্রু নাই। যেহেতু এরা নাজুক তাই এরা ভূমিতে বসবাস ছেড়ে দিয়েছে ভূমিতে বাস করা নানা শিকারি প্রাণীর ভয়ে। এমনকি পানি খেতেও এরা নিচে নামে না। গাছের পাতায় যেটুকু পানি জমে ও খাবারে যে পানি থাকে সেটুকুতেই এরা বেঁচে থাকা শিখেছে।
অনেকটা একই রকম নাজুক দেহ নিয়ে কিভাবে তাহলে ভুমিতে মানুষ সফল ভাবে বাস করে বংশবৃদ্ধি করে এ পর্যন্ত এসেছে? মানুষকে তো উচ্চ ক্যানোপিতে পালিয়ে রক্ষা পেতে হয়নি। তাহলে কি বিশেষত্ব দিয়ে সে প্রকৃতির বিরূপ পরিস্থিতি, খাদ্য সংগ্রহে প্রতিযোগিতা আর হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ থেকে বেঁচে টিকে আছে?
সেটা হল ভিশনারি। বিপদ ঘটার আগেই তার পরিস্থিতি আঁচ করে সঠিক কৌশল অবলম্বনের ক্ষমতা। এই জঙ্গলে প্রবেশের সময় থেকে আমার মনে যে দ্বিধা ও চিন্তা ছিল, ছিল ভয় ও শঙ্কা। এগুলো আমার পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা থেকে আমাকে আমকে গাইড করেছে বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ একটি পরিস্থিতিতে নিজেদের রক্ষা করে সফল হতে। এটাই সেই বিশেষত্ব।
আমার সবসময় মনে হয়েছে মানুষের মগজ এত জটিল এবং ক্ষমতাশালী কেন? আগে তো বই ছিল না, জ্ঞান বিজ্ঞান লিপিবদ্ধ রাখা যেত না। জটিল সব তত্ত্ব, গণিত, যন্ত্রপাতি ছিল না, মানুষ খাদ্য সংগ্রহ করত আর তৃপ্ত হলে ঘুমিয়ে যেত, ডিপ থট কম্পিউটারকে দাবায় হারিয়ে দেবার মত এত মগজের শক্তি মানুষের মাথার কেন হল? দুনিয়ার বেশীরভাগ কম্পিউটারের যতটা প্রসেসিং ক্ষমতা তার এক শতাংশেরও কম আসলে ব্যবহৃত হয়। মানুষের মগজ নিয়ে যারা কাজ করেছেন, তারা দেখেছেন মানুষের মগজের জন্যও বিষয়টা সত্য মানুষের মগজের ক্ষুদ্র অংশই চেতন মনের বিভিন্ন কাজ ও চিন্তায় ব্যবহৃত হয়। বাকিটুকু বিবর্তিত হয়েছে তাহলে কেন?
এর জবাব হলো আমাদের মগজে আমরা ভার্চুয়ালি সিচ্যুয়েশন রিপ্লিকেট বা মডেলিং করতে পারি, তারপর সেটা সিম্যুলেট করে মনের পর্দায় ভিজ্যুয়ালাইজ করতে পারি। সেই ছোট বেলা থেকে আমরা যা করি এবং তার যে ফল হয়, সেটা হোক আনন্দ বা বিষাদ, যেটা আমাদের মনে দাগ কাটে। সেই অভিজ্ঞতা আমাদের অবচেতনেই অভিজ্ঞতা ও মূল্যবোধ হিসাবে লং টার্ম মেমোরিতে জমা হতে থাকে। এর সাথে সাথে আমরা অন্যদের জীবনের যে অভিজ্ঞতা শুনি বা পড়ি সেটাও যদি আমাদের মনে দাগ কাটে সেটাও সেই অভিজ্ঞতা ও মূল্যবোধের খাতায় জমা হতে থাকে। অতীত জীবনের এই সঞ্চিত অভিজ্ঞতা আমাদের প্রতিদিনের প্রতিটা কাজের জন্য একটা সেইফ অপারেটিং গাইডলাইন তৈরী করে দেয়। এই গাইডলাইনের বাইরে গেলেই আমাদের মনে শঙ্কা, অস্থিরতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দিতে থাকে আর ভেতরে থাকলে আত্মবিশ্বাস তৈরী করে যেটাকে গাট ফিলিং বলা হয়ে থাকে।
আমি যখন ঢাকা থেকে মোটরবাইক চালিয়ে পদ্মা সেতু যাই, পোস্তগোলা সেতু পার হলেই বাইকের গতি ১০০-১২০ ছুঁতে শুরু করে অথচ আমি নিশ্চিন্ত থাকি। তখন যদি বৃষ্টি নামে ও রাস্তা ভিজে যায় তার পর ৭০-৮০ এর উপরে গতি উঠাতে আমি চাইলেও, শরীরের ভেতর থেকে প্রতিরোধ আসে। এই গাট ফিলিং আমাদের সেই নিরাপত্তা রক্ষাকবজ যেটা আমাদের শুধু উচ্চ গতিই নয়, সকল রকমের ভবিষ্যত বিপদ থেকে রক্ষা করে এবং অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও সফল কৌশলটি বেছে নিতে সহায়তা করে।
এই গাট ফিলিং বিবর্তিত হয়েছে শুধু বন্য জন্তু ও ফিজিক্যাল সেফটির জন্য নয়, মানুষের বসবাসের স্থানের পরিবেশ প্রকৃতি, পারিপার্শিকতা এবং অন্য মানুষদের বুঝতে ও তাদের সাথে শঙ্কা বিহিন মনোজাগতিক সম্পর্ক স্থাপন করতেও সেটা কাজে লাগে। এই সিম্যুলেটেড রিয়ালিটি ও অ্যাসেসমেন্টের জন্যই প্রয়োজন হয় আমাদের বেশীরভাগ মগজের ক্ষমতা। সেটি যখন সমগ্র মানবতায় বিস্তৃত হয় এবং প্রজন্ম প্রজন্মান্তরের টিকে থাকার বিষয়টাতে যুক্ত হয় তখন সেটা আমার নিজের চাল চলনের জন্য একটা সামগ্রিক বা ইউনিভার্সাল সাসটেইনিবিলিটির গাইডলাইন তৈরী করে।
এই গাইডলাইন আমাদের অবচেতন মনে তৈরী হয় ও এর থেকে আমাদের আচরণ বিচ্যুত হলেই আমাদের মনে শঙ্কা, অস্থিরতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাবের সংকেত বেজে ওঠে। এই গাইডলাইন অনেক সময়ই ব্যক্তিস্বার্থ, দলীয় স্বার্থ বা ব্যক্তি স্বাধীনতার অন্তরায়। তাই আমরা অনেকেই নিজের মনের ভেতরের এই গাট ফিলিং এর সাথে সংযোগটি বন্ধ করে দেই। আমরা মনে করি তাতে আমরা প্রতিদিন নতুন, বীরত্বপূর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণ, নিষিদ্ধ, অপরাধ প্রবণ নানা কিছু করলেও নিজের মনের কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। কিন্তু এর ফল হল নিজের চেতন মনের সাথে অবচেতন মনের সংযোগ বন্ধ হওয়া। এই দুটোর মধ্যে তখন শত্রুতা তৈরী হয়ে যায়। তারা আর একজনের মুখ আর একজন দেখতে চায় না। তখন আর একা একা কিছু না করে সময় কাটানো যায় না। নিজের সাথে নিজ একা হলেই বাধে নিজের মনেই বিশ্বযুদ্ধ। এটাই এরিখ ফ্রমের আত্ম থেকে পলায়ন বা এসকেপ ফ্রম সেল্ফ।
আধুনিক মানুষরা আমরা অবচেতনের এই বিশাল ক্ষমতাটিকে শুধু অবজ্ঞাই করছি না, অব্যবহৃত ও অশিক্ষিত রেখে দিচ্ছি। এই অবচেতনেই মানুষ অতীতে সবসময় বাস্তব জীবনের একটি রেপ্লিকা বা মডেল মনের মধ্যে তৈরী করেছে। সেটাকে সে বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে তার মাথার মধ্যে সবসময় জ্ঞানী পরামর্শদাতা ও নির্ভরতার বন্ধু হিসাবে। নিজের সাথে বন্ধুত্ব আর আস্থা তৈরী না হলে আর একজনের সাথে সেটা হবে কিভাবে? মাতা পিতা স্ত্রী, সকল প্রেমিকারা, পছন্দের সব মানুষ, প্রিয় ব্যক্তিরা শুধু চেহারা কল্পনায় নয়, প্রতিটি মানুষ তার মগজের মধ্যে তাদের মূল্যবোধ সহকারে ভার্চুয়াল চরিত্র হিসাবে জীবন্ত ছিল। প্রতিটি মানুষ এই চরিত্রগুলোর সাথে কথা বলেছে, ভার্চুয়াল সম্পর্ক তৈরী করেছে যার ফলে তাদের বাস্তব রক্ত মাংসের প্রতিরূপ মানুষটি হয়েছে আরও বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য। আধুনিক মানুষেরা মনের মধ্যকার এই জগতকে এড়িয়ে যাবার ফলে কাছের মানুষও তাদের কাছে অচেনা, আনপ্রিডিক্টেবল। এক ছাদের নিচে বাস করও তাই তারা অপরিচিত। কাছে থাকলেও অন্তরে দুরে থাকে তাই তারা আসলে একা। তারা কার্গো সিনেমার ‘দি গাল’ জাহাজের এক একটা সি-গাল। সারা দুনিয়া ধ্বংস হয়ে গেলেও তাই তাদের কিছুই যায় আসে না, তাদের যেটা এখন ইচ্ছা হয়েছে সেটা মেটাতে তারা তাই যা খুশি তাই করতে পারে।
"একজনকে জানা এবং আর একজনকে না জানা নিরর্থক;
শুধু সেই জানে যে রপ্ত করে জ্ঞান এবং অজ্ঞান উভয়কে,
যে অভিজ্ঞতার মাধমে শেখে ভেতরের জগত ও বাইরের জগত উভয়কেই,
সে ই শুধু আনন্দ প্রাপ্ত হয় আসন্ন এবং গন্তব্য উভয় জীবনে"।
- ঈশোপোনিষদ
