“এবং নিশ্চয়ই আমি মূসাকে কিতাব (তওরাত) দিয়েছি এবং তার পরে ক্রমান্বয়ে রাসুলদেরকে প্রেরণ করেছি, মরিয়ম পুত্র ঈসাকে সুস্পষ্ট প্রমাণ (মু’জিযা) দিয়েছি এবং ‘পবিত্র আত্মা’যোগে (রূহুল কুদুস) তাকে শক্তিশালী করেছি। অতঃপর যখনই কোন রাসুলেরা এমন কিছু (ঐশ্বরিক বার্তা) এনেছে যা তোমাদের মনঃপুত নয়, তখন তোমরা অহঙ্কার করেছ, অতঃপর (নবীদের) একদলকে তোমরা মিথ্যাবাদী বলেছ আর একদলকে হত্যা করেছ”। - সূরা আল-বাকারা (২:৮৭)
শহরের সফল, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং অতি মেধাবীদের সাথে আড্ডায় রাজনীতি নিয়ে কথা উঠলেই দেখা যায় তারা রাজনীতিবীদদের মামুলি চারিত্রিক খুঁত বিচারের চিন্তা থেকে বের হতে পারে না। সেদিন এক সিনিয়র চিকিৎসককে বললাম চিকিৎসা পেশায় একজন ডাক্তার কত দক্ষ সেটা কি তার মামুলি ব্যক্তিগত চরিত্র, তার আচার ব্যবহার, তার সততা, তার ভদ্রতার উপর নির্ভর করে? তিনি বললেন, না। আমি বললাম তাহলে একজন রাজনীতিবিদ কেমন, সেটা বিচারে রাজনীতির বিচার না করে তার মামুলি ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে আমরা তার বিচার করি কেন?
বিশ্বখ্যাত ইনভেস্টর এবং বিলিয়নিয়ার চার্লি মুঙ্গার একবার এই বিষয়টা নিয়ে একটু খুব মূল্যবান কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন আমরা ভাল মানুষ খুঁজি এবং যে এমন মানুষ খুঁজি যে অনেক কিছু সম্পর্কে জ্ঞান রাখে। কিন্তু ধরুন আপনার গুহ্যদ্বারে বাজে একটা ফিস্টুলা হয়েছে, অপরেশন করতে হবে, যে সার্জন পলিটিক্যাল সায়েন্সে খুব ভাল জ্ঞান রাখে, তার কাছে অপারেশন করাবেন? একজন সৎ সার্জন খুঁজবেন নাকি একজন দক্ষ সার্জনের কাছে যাবেন?
মানব বিবর্তনের শুরুতে যখন বিভিন্ন গোত্রগুলো আকার বড় হল, সম্পদশালী হল এবং সর্বদা নিরাপত্তা চিন্তা থেকে বের হয়ে একটি শান্তিপূর্ণ বহু-গোত্র সমাজ গঠনে উদ্যত হল তখন থেকেই নগর রাষ্ট্র এবং শাসনের রাজনীতির সূচনা। সেই সময় ধর্ম ও ঈশ্বরের ধারণা এবং রাষ্ট্র এবং শাসনের রাজনীতি একসাথে মিশ্রিত হয়ে গিয়েছিল।
প্রখ্যাত দার্শনিক হেগেল বলে গেছেন একটা রাষ্ট্র হচ্ছে দুনিয়ার বুকে ঈশ্বরের পদযাত্রা। সেই রাষ্ট্র যারা প্রতিষ্ঠা করে তাদের ঈশ্বরের মত গুণাবলী থাকতে হয়। এখানে ঈশ্বরের মত বা ‘ঐশ্বরিক’ মানে ধর্মীয় ঈশ্বর নয়। এখানে ‘ঐশ্বরিক’ মানে সামগ্রিক মানবীয় আদর্শের যার মূল ভিত্তি, যোগুলো হল মানুষের কল্যাণ, নিরাপত্তা ও সর্বপরি ন্যায়বিচারের গুণ। রাষ্ট্রের অর্থ হচ্ছে তার নাগরিকের সাথে একটি অলিখিত চুক্তি। যে চুক্তি হয় ঐশ্বরিক সংজ্ঞায় ও প্রতিজ্ঞায়।
হিন্দু, গ্রীক পুরাণ থেকে শুরু করে তওরাত, বাইবেল, কোরানে আমরা যে সব দেব, দেবী ও নবী, রাসুলদের দেখি তারা প্রায় সবাই শাসক ছিলেন। বিবর্তনের সেই ধারা থেকে মনের অজান্তেই আমরা বর্তমানের রাজনীতিবিদদের উপরও ঐশ্বরিক বা ‘পবিত্র আত্মা’র গুণাবলী আরোপ করে ফেলি। এটা একটা চিন্তাগত ভ্রান্তি বা কগনিটিভ বায়াস।
ঈশ্বরের প্রতিনিধি বা বার্তাবাহক হলেও নবী রাসুলেরা ছিলেন রক্ত মাংসের মানুষ। সেই মানুষদের মানবিক ত্রুটি থাকবেই। সেই ত্রুটি তুলে ধরে তাদের হেয় করা, মিথ্যাবাদী বলা বা তাদের হত্যা করা নিয়েই সাবধান করা হয়েছে সূরা আল-বাকারাতে (২:৮৭) “অতঃপর যখনই কোন রাসুলেরা এমন কিছু (ঐশ্বরিক বার্তা) এনেছে যা তোমাদের মনঃপুত নয়, তখন তোমরা অহঙ্কার করেছ, অতঃপর (নবীদের) একদলকে তোমরা মিথ্যাবাদী বলেছ আর একদলকে হত্যা করেছ”।
স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের প্রতীক দেবী এথেনা ছিলেন গ্রিক পুরাণে একজন শক্তিশালী ও সম্মানিত দেবী। তিনি ছিলেন মহা শক্তিশালী দেবতা জিউসের কন্যা। তিনি জ্ঞান, শিল্পকলা এবং যুদ্ধের কৌশলের জন্যই নয়, বয়নশিল্প এবং হস্তশিল্পেরও দেবী ছিলেন। এথেন্সের প্রতিষ্ঠা পুরাণে, এথেনা প্রথম জলপাই গাছ তৈরি করে শহরের পৃষ্ঠপোষকতার প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বীরত্বপূর্ণ প্রচেষ্টার পৃষ্ঠপোষক দেবী। আফ্রোদিতি এবং হেরার সাথে , অ্যাথেনা ছিলেন তিন দেবীর একজন যাদের দ্বন্দ্বের ফলে ট্রোজান যুদ্ধ শুরু হয়।
রোমান কবি ওভিডের "মেটামরফোসিস" গ্রন্থে দেবী এথেনা ও নিজ পেশায় দক্ষ সাধারণ মানুষ অ্যারাকনির একটি গল্প বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। এথেনা ও অ্যারাকনির গল্পটি গ্রিক পুরাণের একটি উল্লেখযোগ্য কাহিনী, যা অহংকার, প্রতিযোগিতা এবং শাস্তির মাধ্যমে মানব প্রকৃতি ও দেবতাদের সাথে সম্পর্কের গভীর দিক তুলে ধরে। এই গল্পটি এটি এথেনা, যিনি জ্ঞান, যুদ্ধ এবং হস্তশিল্পের অমর দেবী, এবং অ্যারাকনি নামে একজন মরনশীল মানবীয় নারীর মধ্যে একটি নাটকীয় সংঘর্ষের গল্প।
অ্যারাকনি ছিলেন বর্তমান তুরস্কের একটি অঞ্চল লিডিয়ার একজন সাধারণ নারী। তিনি একজন অসাধারণ বয়নশিল্পী ছিলেন। বুননকর্মে যার দক্ষতা এতটাই অতুলনীয় ছিল যে তার কাজ দেখে মানুষ মুগ্ধ হতো।
অ্যারাকনির বাবা ইডমন ছিলেন একজন রঞ্জক, যিনি বেগুনি রঙের কাপড় তৈরি করতেন। তার পরিবার সাধারণ হলেও অ্যারাকনির প্রতিভা তাকে বিখ্যাত করে তুলেছিল। লোকেরা বলতে শুরু করে যে তার দক্ষতা বয়নশিল্পের দেবী এথেনার থেকেও উৎকৃষ্ট। এই প্রশংসা অ্যারাকনির মনে অহংকার জন্ম দেয়।
একদিন গ্রামের মানুষ অ্যারাকনির বয়নশিল্পের প্রশংসা করতে করতে বলে, "তোমার দক্ষতা নিশ্চয়ই দেবী এথেনার কাছ থেকে শেখা, কারণ এত সুন্দর কাজ দেবতদের পক্ষেই সম্ভব, মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।" এই কথায় অ্যারাকনি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। তিনি অহংকারের সাথে বললেন, "আমি এথেনার কাছ থেকে কিছুই শিখিনি। আমার দক্ষতা আমার নিজের। বরং আমি বলব, আমার কাজ এথেনার চেয়েও ভালো। তিনি যদি সাহস করেন, তবে আমার সাথে প্রতিযোগিতা হোক। দেখা যাক কে জিতে!"
এই কথা দেবী এথেনার কানে পৌঁছে যায়। দেবতারা মানুষের অহংকার সহ্য করতেন না, বিশেষ করে যখন কেউ তাদের চ্যালেঞ্জ করত। এথেনা সিদ্ধান্ত নিলেন অ্যারাকনির অহংকারের পরীক্ষা নেবেন।
এথেনা প্রথমে একজন বৃদ্ধার ছদ্মবেশে অ্যারাকনির কাছে যান। তিনি অ্যারাকনিকে সতর্ক করে বললেন, "তুমি অত্যন্ত দক্ষ, কিন্তু দেবতাদের সাথে নিজেকে তুলনা করা ঠিক নয়। দেবী এথেনার কাছে ক্ষমা চাও, তিনি তোমাকে ক্ষমা করবেন।" কিন্তু অ্যারাকনি তার অহংকারে অটল থেকে বললেন, "আমি ক্ষমা চাইব না। এথেনা যদি আমার থেকে ভালো হন, তবে তিনি এসে আমার সাথে প্রতিযোগিতা করুন।"
এথেনা তখন তার আসল রূপ প্রকাশ করলেন। তিনি তাঁর দেবীত্বের জাঁকজমক নিয়ে অ্যারাকনির সামনে দাঁড়ালেন। প্রতিযোগিতা শুরু হলো। দুজনেই তাঁতের সামনে বসলেন এবং বয়ন শুরু করলেন।
দেবী এথেনা তার কাপড়ে একটি মহৎ ঐশ্বরিক দৃশ্য বুনলেন। তিনি দেবতাদের গৌরব এবং মানুষের প্রতি তাদের শক্তি দেখালেন। তার কাজে ছিল এথেন্স শহরের জন্মের গল্প, যেখানে তিনি পসাইডনের সাথে প্রতিযোগিতায় জিতে শহরটির পৃষ্ঠপোষকতা পান। তার কাজ ছিল ইতিবাচক, জন্মের, গঠনের, একত্রিকরণের যা চিল নিখুঁত, রঙিন এবং দেবত্বপূর্ণ। তিনি আরও চারটি ছোট দৃশ্য যোগ করলেন, যেখানে মানুষ দেবতাদের বিরুদ্ধে গিয়ে শাস্তি পেয়েছে। এটি অ্যারাকনির জন্য একটি সতর্কবার্তা ছিল।
অ্যারাকনি তার কাপড়ে দেবতাদের যত দুর্বলতা ও অনৈতিক কাজের চিত্র তুলে ধরলেন। তিনি জিউসের বিভিন্ন প্রেমের গল্প বুনলেন, যেমন তিনি কীভাবে লিডা, ইউরোপা এবং অন্যান্য নারীদের প্রতারণা করেছিলেন। তিনি পসাইডন, অ্যাপোলো এবং অন্যান্য দেবতাদেরও তাদের অসৎ কাজের জন্য উপহাস করলেন। তার কাজ ছিল কারিগরীভাবে নিখুঁত এবং অত্যন্ত বিস্তারিত, যা দেখে এমনকি এথেনাও মুগ্ধ হলেন। কিন্তু তার কাজ ছিল নেতিবাচক, স্খলন, পতন, ভ্রম; বিকলতা, বিকৃতি নির্ভর যা উপহাস ও সমালোচনার।
প্রতিযোগিতা শেষে এথেনা অ্যারাকনির কাজ পরীক্ষা করলেন। তিনি দেখলেন যে অ্যারাকনির কাজ শুধু নিখুঁতই নয়, বরং তার নিজের কাজের সমকক্ষ বা কিছুটা উৎকৃষ্টও। কিন্তু অ্যারাকনির নেতিবাচক বিষয়বস্তু, দেবতাদের প্রতি উপহাস, সমালোচনা এথেনাকে ক্রুদ্ধ করল।
তিনি অ্যারাকনির অহংকার এবং অপমান সহ্য করতে পারলেন না। ক্রোধে এথেনা অ্যারাকনির তাঁত ভেঙে ফেললেন এবং তার কাপড় ছিঁড়ে দিলেন। অ্যারাকনি লজ্জায় ও ভয়ে নিজেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন। কিন্তু এথেনা তাকে মরতে দিলেন না। তিনি অ্যারাকনিকে একটি মাকড়সায় রূপান্তরিত করলেন। এথেনা বললেন, "তুমি চিরকাল বুনে যাবে, কিন্তু মানুষের প্রশংসা পাবে না। তোমার জাল তোমার শিল্প হবে, কিন্তু তুমি চিরকাল ঝুলে থাকবে।" এভাবে অ্যারাকনি মাকড়সা হয়ে গেলেন, এবং তার বংশধররা আজও জাল বুনে চলেছে।
পাকিস্তান প্রভাবিত আমাদের সামরিক বাহিনী, আমাদের কিছু এনজিও, প্রায় সব সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া মার্কিন ডিপ স্টেট এবং জর্জ সোরোস চক্রের অর্থে ও প্রভাবে গত ৫০ বছর ধরে এদেশে রাজনীতিবিদদের চরিত্রহননের পাপোষ বুনে চলেছে। তাদের সেই বুনন অ্যারাকনির মতই যথেষ্ট আকর্ষনীয়, কারিগরীভাবে নিখুঁত এবং অত্যন্ত বিস্তারিত। কিন্তু তাদের কাজ নেতিবাচক, স্খলন, পতন, ভ্রম; বিকলতা, বিকৃতি নির্ভর যা উপহাস ও সমালোচনার। এরাও মাকড়সা হবে, এরাও চিরকাল বুনে যাবে, কিন্তু মানুষের প্রশংসা পাবে না। এদের জালও শিল্প হবে, কিন্তু কোন ইতিবাচকতা ছাড়া। পরাধীন হয়ে এরাও চিরকাল পরনির্ভর হয়ে ঝুলে থাকবে।
দেবতারা, নবী রসুলেরা বা রাজনৈতিক নেতারা আত্ম বিসর্জন দিয়ে বিশাল কিছুর জন্য কাজ করেন। মানবিক ত্রুটি তুলে তাদের বিচার করা যায় না। এটি করতে যারা দলবেঁধে লেগে পড়ে, তারা মানসিকভাবে সীমাবদ্ধ। তারা তাদের নিজেদের ভবিষতকেই পরাধীনতা, পরনির্ভরতা ও অন্যায় অবিচারের জালে আটকে ফেলে।