সেটা দুই হাজার তিন বা চারের দিকের ঘটনা কোন এক ঈদের ছুটির সময়। বেশ লম্বা একটি সময় হাতে নিয়ে সুন্দরবন চলে গেলাম। গাইড ট্যুরসের ট্যুর বোটগুলো ঈদের সময় ব্যস্ত হয়ে পড়ে ঈদের ছুটিতে অতিরিক্ত টুরিস্টের চাপ সামলাতে। সুন্দরবনে ট্যুর ব্যবসা সিজনাল। চাপের সময় রাতদিন কাজ করে ডাল সিজনের খরচ তুলতে হয়। সাধারণ ট্যুরগুলোর বনে অবস্থান খুব অল্প সময়ের। বেশিরভাগ সময় যায় প্রধান টুরিস্ট লোকেশন কটকা পর্যন্ত যাওয়া আসাতে। বোটে ভালা খাওয়া দাওয়া থাকে বলে টুরিস্টরা এতেই খুশি।
আমরা যারা ফটোগ্রাফি করি বা বনে বেশি সময় থাকতে চাই তারা এটা পছন্দ করি না। নেচার ট্রাভেল সাইট সিইং নয়। অথচ ট্যুরগুলো সাজানো সাইট সিইং এর আদলে। সেবার পরিকল্পনা করলাম একটি ট্যুর বোটে যাব, মাঝখানে কয়েকদিন একটি ট্রলারে (ছোট বোট) থাকব এবং আর একটি টুরিস্ট বোটে ফিরে আসব। এতে আমার প্রায় দিন দশেক বনের ভেতরে থাকা হবে।
গাইড ট্যুরসের বন্ধুরা বনবিভাগের পারমিট সহ সব ব্যবস্থা করে দিলেন। সবার মনে শুধু একটি শঙ্কা, দুই ট্রিপের মাঝে কটকা এলাকায় থাকব শুধু আমি এবং একজন ট্রলার চালক। তখন সুন্দরবনে টুরিস্ট বোটের সংখ্যা মাত্র তিনটি। কটকা এলাকা দিয়ে ডাকাতের আনাগোনা আছে। কোন ডাকাতের নৌকা যদি উৎসাহী হয়ে ওঠে এটাই ভয়। বাঘের ভয় আমরা যারা বনে যাই তারা ততটা করি না কারণ বন্যপ্রাণী তার আচার ধর্ম মেনে চলে, মানুষ বিকৃত মনের হলে তারা সেটা চলে না।
শুন্য কটাকায় ভয়ে ভয়ে রাতটা কাটাবার পর বেশ সকালেই আমার ছয় কেজি ওজনের ক্যানন ৪০০ মিলিমিটার এফ/২.৮ লেন্সটা নিয়ে কটকা টাওয়ারে উঠে গেলাম। আশা এই যদি বাঘের দেখা মেলে কটকা মোডোটা (ঘেষো মাঠ) পার হতে। এছাড়া হরিণ পাখি এগুলোও পাওয়া যায়। বনের ভেতরে একা কখনও হাঁটা উচিত নয় কারণ যে কোন সময় কোন বিপদ ঘটা অসম্ভব নয় এবং একা থাকলে যদি ফিরে আসা সম্ভব না হয় তাহলে কেউ জানতে পারবে না আমার অবস্থান। এই কারণেই এই টাওয়ারে থাকার পরিকল্পনা।
তখন বেলা দশটা নাগাদ হবে হঠাৎ শুনি একটি বোটের শব্দ ও বেশ কিছু মানুষের কথাবার্তা। আগেই বলেছি বনে একমাত্র ভয় মানুষের। জনমানবহীন এই বনে কোন দুষ্ট লোকের দল যদি কোন অপকর্ম করে, তাদের আটকানোর বা সাহায্য চাইবার কেউ নেই। তখন ওই এলাকা মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে ছিল। দেখলাম এক ব্যক্তি প্রচন্ড জোরে জোরে কথা বলতে বলতে আসছে এবং তার পেছনে গোটা আটেক লোক।
আমি আমার কাজে ব্যস্ত রইলাম। ঐ ব্যক্তি তার দুজন সঙ্গী সহ টাওয়ারের উপরে এলেন। আমাকে প্রশ্ন করলেন আপনি কে। আমি বললাম আমি একজন বন্যপ্রাণী ফটোগ্রাফার। আমার বিশাল লেন্সটা দেখে তিনি অবাক হয়ে বললেন এতবড় লেন্স? এটা দিয়ে কতদুর দেখা যায়। এটা বড় লেন্স দেখে মানুষের কমন প্রশ্ন এবং এর উত্তর দেওয়া কঠিন। সব লেন্স দিয়েই দুরের সবকিছু দেখা যায়, বড় লেন্স দিয়ে সেটা উজ্জলতর দেখা যায় বা বড় দেখা যায়।
ঐ ব্যক্তির গলায় ঝুলছিল একটি এসএলআর ক্যামেরা সস্তা জুম লেন্স লাগানো কিন্তু যেটা ক্যানন নয়, সম্ভবত ছিল অলিম্পাস বা পেন্টাক্স। তিনি আমার ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে চোখ রেখে দেখলেন। তারপর নিজের ক্যামেরা থেকে লেন্সটা খুলে বডিটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন আমার এইটা লাগান। আমি হেসে বললাম আমার এটাতো ক্যানন লেন্স এটা তো ওই বডিতে লাগানো যাবে না।
তিনি হঠাত ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন। বলে উঠলেন জানেন আমি কে? আমি এই বনের রাজা। আমি চিনতাম না যে তিনি তখন ডিএফও যার অধীনে ঐ বন এলাকা। আমাকে তিনি চার্জ করলেন এই বলে যে আপনি আমাকে চেনেন না আপনি এই বনে ঢুকলেন কিভাবে? আমি বললাম ট্যুর কোম্পানী আমাকে এখানে আসার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
এর পর তিনি কটকা মেডোর দিকে তাকালেন। ঘাস কাটা ও টুরিস্ট সিজনের আগে কটকা মেডোটা তখন সুন্দর টাইগার ফার্ন ও নানা ঝোপ লতায় ভরে গেছে। তিনি তাঁর সঙ্গীদের দিকে ফিরলেন, বললেন এখানে এত জঙ্গল কেন? তার সঙ্গীরা বলল স্যার জঙ্গল থাকলে বাঘ আসবে। তিনি বলে উঠলেন না না না বাঘের দরকার নাই, হরিণ দরকার হরিণ। সব জঙ্গল জ্বালিয়ে দাও। পরে শুনেছি তিনি পিএইচডি করেছেন ও বই লিখেছেন হরিণের উপর, বাঘের উপর নয় তাই বাঘ দরকার নেই। পরদিন সকালে টাওয়ারে গিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। দেখলাম বিশাল মেডোটার সমস্ত জঙ্গল আগুনে জ্বালানো যতদুর চোখ যায়।
এই ব্যক্তিই পরবর্তীতে বন্যপ্রাণী বিভাগের প্রধান হন। ২০১২ সালে যে তিনটি বাঘের বাচ্চা পাচার হবার সময় ধরা পড়ে, ধৃত পাচারকারীরা স্বীকারোক্তি দেয় যে এই ব্যক্তিই তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন এই বাচ্চাগুলো সুন্দরবন থেকে ধরে বিদেশে পাচার করতে। যেগুলো আবার বহুমূল্যে কিনে সাফারি পার্ক নামে যে সার্কাস তৈরী করছে বনবিভাগ, সেখানে বিক্রয় করা হয়ত উদ্দেশ্য ছিল। ঐ ব্যক্তি এখনও সক্রিয়। সিলেট অঞ্চলে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে যে সাফারি পার্ক করার পাঁয়তারা হচ্ছে তার প্রধান উদ্যোক্তা এই ব্যক্তি।
সম্প্রতি গেল বিশ্ব বাঘ দিবস। এদেশে যারা বাঘ রক্ষায় সরকারী দায়িত্বপ্রাপ্ত তারাই বাঘের বাচ্চা পাচার করে হাতেনাতে ধরা পড়লেও তাদের কিছুই হয় না, বরং বন্যপ্রাণী বিভাগের প্রধান হয়ে যায়। এদেশে সরকারী কর্মকর্তারা পিতৃহন্তারক, মাতৃকামি। তারা জাতীর পিতাকে হত্যা করেছে এবং দেশমাতৃকাকে ধর্ষণ করে যাচ্ছে। শুধু তাদের অপকর্ম আর নির্বুদ্ধিতায় শেষ হয়ে যাচ্ছে বাঘের একমাত্র আবাসস্থল সুন্দরবন সহ সকল বন।
সর্বত্র এটি দেখেও জনগন নীরব। সবচেয়ে হতাশার হল তরুণ প্রজন্ম এদের ঘৃণা না করে এদেরকেই আইডল ভাবছে। বিসিএসই তাদের স্বপ্ন। এর চেয়ে হতাশার আর আর কিছু হতে পারে না। আমাদের সামনে নিকষ কালো অন্ধকার। পরবর্তী প্রজন্মকে আমরা দিয়ে যাচ্ছি এক বিভিষিকাময় বাস্তবতা।
ছবি: সেই তিনটি বাঘের বাচ্চা পাচার হবার সময় ধরা পড়লে তারা খাবার না পেয়ে ডিহাইড্রেশনে মৃতপ্রায় হয়ে যায়। তাদের দেওয়া হচ্ছিল গরুর দুধ সেটা তারা হজম করতে পারে না। এদেশে কেউ জানত না কিভাবে তাদের বাঁচানো যায়। আমি আমার এক ডাচ বন্ধুর সহযোগীতায় থাইল্যান্ড থেকে তারই প্রতিষ্ঠানের একটা টিম আনি ভেটসহ যারা ঐ বাঘ তিনটির ছয় মাসের খাবার সহ এখানে এসে তাদের সকল বিপদমুক্ত করে দিয়ে যায়। পুরোটাই ছিল আমার ও তাদের ফ্রি কনট্রিবিউশন। এর জন্য আমরা কারো কাছ থেকে কোন অর্থ নেইনি। ঢাকা বোটানিক্যাল গার্ডেনে একটি কক্ষে সেই তিনটি বাচ্চার একটির সাথে আমি।