অনেকদিন পর সুন্দরবনে যাচ্ছি, সন্ধ্যার আলো আঁধারীতে নদীপথে খুলনা শহর থেকে বের হতেই নদীর পাড়ে সোনালী রঙের তিনটি গম্বুজ দেখে সহযাত্রী এক বিদেশী প্রশ্ন করল এটা কি? গম্বুজ মানে মসজিদই হবার কথা যদিও মিনার নেই। আমার মনে প্রশ্ন সোনা বা সোনালী রং আর ইসলাম ঠিক যায় না। এটা কি কোন মাজার? নাকি অন্য কোন ধর্মের উপাসনালয়? বাইনোকুলারটা এনে চোখ লাগাতেই মাইক চোখে পড়ল। গুগল ম্যাপ দেখে ও মাইক দেখে মনে হল মসজিদই। তবু মনে খটকা, সোনালী কেন? সোনালী রং সোনা ছাড়া প্রস্তুত করা যায় না।
বিখ্যাত জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদের গম্বুজ সোনালী বলে অনেকে ভুল করে। আসলে জেরুজালেমের বাইতুল মুকাদ্দাস বা আল আকসা একটি প্রাঙ্গণের নাম, সেখানে থাকা মসজিদটির নাম আল কিবলি মসজিদ। মসজিদ আল কিবলিই আল আকসা মসজিদ হিসাবে পরিচিত। মসজিদ আল কিবলির গম্বুজ সোনালী নয়, সেটির রং ধুসর। সোনায় বাধানো সোনালী গম্বুজওয়ালা যে দালানটিকে মানুষ জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদ মনে করে সেটা আল আকসা এলাকার ভেতরে অবস্থিত ইহুদি, খ্রীস্টান ও মুসলিম ধর্মের একটি পবিত্র স্থান যার নাম ‘দ্য ডোম অফ দ্য রক’। যাকে আরবিতে বলা হয় কুব্বাত আস সাখরা। কুব্বাত আস সাখরা অর্থ হল ‘পাথরের গম্বুজ’ যেটি জেরুজালেমের পুরনো শহরের টেম্পল মাউন্টের উপর অবস্থিত একটি গম্বুজ। এখানে অবস্থিত সাখরা নামক বিশেষ পাথরটির কারণে স্থানটি ইব্রাহিমীয় ধর্মগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
বাইবেলের আদি পুস্তক (ওল্ড টেস্টেমেন্ট) এর জেনেসিসে বলা হয়েছে ইসমায়েলের পুত্র জ্যাকব (মুসলিমদের ইয়াকুব নবী) বীর শিবা থেকে বেরিয়ে হারানের দিকে যাচ্ছিলেন। বাইবেলে বর্ণিত বীর শিবা বর্তমানের ইসরাইলের একটি এলাকা আর হারান বর্তমানের তুরস্কে। কিছুদুর অগ্রসর হয়ে সন্ধ্যা নামলে পথেই একটি পাথরে মাথা রেখে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমের মধ্যে তিনি স্বপ্ন দেখেন যে, যে পাথরে মাথা রেখে তিনি ঘুমিয়েছেন সেটা থেকে শুরু হয়ে পৃথিবী থেকে একটি সিঁড়ি উপরে বেহেশত পর্যন্ত উঠে গেছে। সেটা দিয়ে আল্লাহর ফেরেশতারা ওঠানামা করছে। স্বপ্নে সেই সিড়ির সর্বোচ্চো ধাপ থেকে আল্লাহ তাকে জানালেন, যেখানে জ্যাকব শুয়ে আছেন, সেই ভূমি তিনি তাকে এবং তার বংশধরকে দেবেন। তার বংশধরেরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। স্বপ্ন দেখে তিনি জেগে উঠলেন। এই সিঁড়ির স্বপ্ন ‘জ্যাকব’স ল্যাডার ড্রিম’ নামে পরিচিত। এটাই মুসলিমদের মেরাজের ধারণার উৎস, যেকারণেই নবী মুহম্মদের মেরাজ যাত্রা মসজিদে হারাম থেকে
আল আকসা এলাকাটি খ্রীষ্টান ও ইসলামপূর্ব যুগে ইহুদি উপাসনালয় ছিল। এটি ইহুদীদের প্রার্থনার কিবলা এবং মুসলিমদেরও প্রথম কিবলা ছিল বহু বছর, এদিকে ফিরেই মুসলিমরা আগে নামাজ আদায় করত মদিনায় হিজরতের ১৭তম মাস পর্যন্ত। ইহুদি নবী রাজা ডেভিড (মুসলিমদের দাউদ নবী) আল্লাহ কতৃক এটি তৈরির নির্দেশপ্রাপ্ত হন এবং তাঁর পুত্র রাজা সলোমন (মুসলিমদের সুলাইমান নবী) এটি নির্মাণ করেন খ্রিস্টপূর্ব ৯৫৭ সালে যেটিকে ইহুদিদের ফার্স্ট টেম্পল বা ‘প্রথম উপাসনালয়’ বলা হয়।
ব্যাবিলনীয় রাজা নেবুচাদনেজার খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে উক্ত এলাকা দখল করে নিলে ‘প্রথম উপাসনালয়’টি ধ্বংস করেন এবং ইহুদিদের তিনি ব্যাবিলনে নির্বাসিত করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সালে বর্তমানের ইরান বা পারস্যের রাজা ২য় সাইরাস, যিনি ‘সাইরাস দ্য গ্রেট’ নামেই বেশি পরিচিত, তিনি আক্রমণ করেন ব্যাবিলন। খোলা মনের ও উদার ন্যাযপরায়ন পারস্যের দ্বিতীয় কুরুশ বা মহান কুরুশ রাজা এই সাইরাস দ্য গ্রেট অনায়াসে ব্যাবিলন জয় করলে তিনি ইহুদিদের তাদের স্বদেশে ফিরে যেতে এবং তাদের উপাসনালয়টি পুনর্নির্মাণের অনুমতি দেন, যা রোমান সম্রাট টাইটাসের আগমন পর্যন্ত আস্ত ছিল। একই অবস্থানে নির্মিত হলে এটি ইহুদীদের ‘দ্বিতীয় উপাসনালয়’ নামে পরিচিত হয়।
সম্রাট টাইটাসের সময় ৭০ খ্রীস্টাব্দে রোমানরা জেরুজালেম দখল করলে ‘দ্বিতীয় উপাসনালয়’টি ধ্বংস করে দেয় ও এর স্থলে দেবতা জুপিটারের মন্দির গড়ে তোলে। চতুর্থ শতাব্দী থেকে মুসলিম বিজয় পর্যন্ত বাইজেন্টাইন আমলে জেরুজালেম খ্রিষ্টান অধ্যুষিত ছিল। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে এটাই সেই জায়গা যেখানে যীশু খ্রিস্ট ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন আর এখানকার গুহাতেই তার দেহ রাখা হয়েছিল। তখন ১০ হাজারের মত তীর্থযাত্রী যিশুর পদচারণার স্থান পরিদর্শন করতে আসত যার মধ্যে এটিও ছিল।
মুসলিমদের উক্ত এলাকা বিজয়ের পর উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের আদেশে ৬৯১ সালে এর বর্তমান অবস্থার নির্মাণ সমাপ্ত হয়। এর স্থাপত্য ও মোজাইক বাইজেন্টাইন চার্চ ও গম্বুজটির কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কাঠামো হলি সেপালকার চার্চের মত।
১০৯৯ সালে খ্রীষ্টান ক্রুসেডাররা জেরুজালেম অধিকার করে নেয়। কুব্বাত আস সাখরাকে তখন অগাস্টিনিয়ান খ্রীষ্টানদের কাছে দিয়ে দেয়া হয়। তারা এটিকে গির্জায় রূপান্তর করে এবং এটি সহ আল-আকসা মসজিদটিকে রাজকীয় প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে।
১১৮৭ সালের ২ অক্টোবর সুলতান সালাউদ্দিন জেরুজালেম জয় করেন। কুব্বাত আস সাখরাকে পুনরায় মুসলিম স্থান হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। এর চূড়ায় স্থাপিত ক্রুশকে সরিয়ে সেখানে ইসলামী চাঁদ স্থাপন করা হয়। গম্বুজের নিচে পাথরের চারপাশে কাঠের সীমানা দেয়া হয়।
প্রথম সুলাইমানের শাসনামলে (উসমানীয় সাম্রাজ্য ১৫১৭-১৯১৭) কুব্বাত আস সাখরার বহির্ভাগ টাইলস দিয়ে আচ্ছাদিত করা হয়। এ কাজের জন্য সাত বছর সময় লাগে। সেই সময় কুব্বাতে আস সাখরার ভেতরটা মোজাইক, কাঁচজাতীয় বস্তু ও মার্বেল দ্বারা সৌন্দর্য বর্ধিত করা হয়েছে।
১৬২০ সালে কুব্বাত আস সাখরার পাশে উসমানীয়রা কুব্বাত আন নবী নামক আরেকটি স্থাপনা নির্মাণ করে।
১৯১৭ সালে বৃটিশ ফিলিস্তিন মেন্ডেটের গ্র্যান্ড মুফতি নিযুক্ত হন মুহাম্মদ আমিন আল হুসাইনি । তিনি কুব্বাত আস সাখরা ও আল আকসা মসজিদের সংস্কার করেন।
১৯৫৫ সালে জর্ডান সরকার আল আকসার সম্প্রসারণমূলক পুনর্গঠন কাজ শুরু করে। আরব সরকারগুলো ও তুরস্ক এতে অর্থ সহায়তা দেয়। ১৯৬৫ সালে এই সংস্কারের অংশ হিসেবে গম্বুজটি এলুমিনিয়াম ব্রোঞ্জ মিশ্রণ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়।
১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধের সময় কুব্বাত আস সাখরার উপর ইসরায়েলি পতাকা উত্তোলনের কয়েক ঘণ্টা পর মোশে দায়ানের নির্দেশে তা নিচু করা হয় এবং শান্তি রক্ষার স্বার্থে টেম্পল মাউন্টের তত্ত্বাবধানের জন্য মুসলিম ওয়াকফে দায়িত্ব দেয়া হয়।
জেরুজালেমের আল আকসা ঠিক কোন মসজিদ নয়, এটা এলাকাটির নাম। সেখানে থাকা মসজিদটির নাম আল কিবলি মসজিদ। কুব্বাত আস সাখরা বা ডোম অফ দ্য রক কোন মসজিদ বা প্রার্থনা স্থান নয়। এর মধ্যে আছে একটা পবিত্র পাথর এবং এই পাথরের সাথে আছে একটা গুহা। এ পাথরটিই হচ্ছে টেম্পল মাউন্টের অন্তর্গত সবচেয়ে পবিত্র জিনিস। যেটি ইহুদি, খ্রীষ্টান ও ইসলাম ধর্মে গুরুত্বপূর্ণ। ইহুদিদের মতে, আল আকসায় ‘ফাউন্ডেশন স্টোন’ বা বিশ্বের ‘ভিত্তি পাথর’ এর অবস্থান। ইহুদিরা বিশ্বাস করে, ‘টেম্পল মাউন্টেই’ তাদের পয়গম্বর আব্রাহাম তার পুত্র ইসমাইলকে উৎসর্গ করার জন্য নিয়ে এসেছিলেন। যেখান থেকে বিশ্বের সৃষ্টি শুরু হয়েছিল বলে তারা বিশ্বাস করে। তাদের সেই উপাসনালয়ের শুধুমাত্র পশ্চিম দিকের দেয়ালটিই এখনো টিকে আছে এবং এটিই ইহুদিদের প্রার্থনার স্থান। অন্যদিকে খ্রিস্টানরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে এটাই সেই জায়গা যেখানে যীশু খ্রিস্ট ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন আর এখানকার গুহাতেই তার দেহ রাখা হয়েছিল। নবী মুহম্মদ যে ঊর্ধ্বাকাশে আরোহণ এবং আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন যাকে মেরাজ বলা হয়, মেরাজ মানে সিড়ি আর কুব্বাত আস সাখরার এই পাথরটিই হলো সেই সিড়ির প্রধম ধাপ।
সেই পাথরটিকেই ঢেকে রাখা হয়েছে একটি গম্বুজ দ্বারা যেটি কুব্বাত আস সাখরা বা ডোম অফ দ্য রক। ১৯৯৩ সালে গম্বুজের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য জর্ডানের রাজা হুসাইন ৮.২ মিলিয়ন ডলার দান করেন। তিনি তার লন্ডনের বাড়ি বিক্রি করে এই অর্থ দিয়েছিলেন। এই টাকা দিয়ে ৮০ কেজি সোনা কেনা হয়। ডোম অফ দ্য রক এর আগে সোনালী ছিল না। সোনায় মোড়া গোল্ড প্লেটেড টাইলগুলো জর্ডানিয়ানরা এর সৌন্দর্য্য বর্ধনের জন্য স্বর্ণ লাগায়। এই স্বর্ণ-ই এখন জ্বলজ্বল করছে এর গম্বুজে।
অনেক ইতিহাস হল সংঘাতময় জেরুজারেমের। আমরা ফিরে আসি খুলনায়। কেন আমার মনে খটকা লাগল সোনালী রঙের গম্বুজ দেখে? উল্লেখ্য এই ৮০ কেজি স্বর্ণ কিন্তু আল আকসা মসজিদের গম্বুজে লাগানো হয়নি। কাবা শরীফের দোয়ালে লাগানো পবিত্র পাথর যে হজরে আসওয়াদ, সেটিও বাঁধানো ধাতু দিয়ে। সেই ধাতু কিন্তু রূপা, সোনা নয়। যদিও হজরে আসওয়াদ ইসলাম ধর্ম অনুসারে পবিত্রতম বস্তু। বলা হয়ে থাকে যেটি আদম ও হাওয়া এর সময় বেহেশত থেকে পৃথিবীতে এসে পড়েছে।
আপনি যদি সত্যিকারভাবে ইসলাম ধর্মকে বুঝতে পারেন তাহলে মসজিদের গম্বুজ স্বর্ণ দেখে আপনার, মনে খটকা লাগবে। ইসলাম ধর্ম দুনিয়াতে এসেছে নীপিড়িত ও সর্বহারাদের ধর্ম হিসাবে। বস্তুগত সম্পদ আহরণ, অট্টালিকা প্রাসাদ ও রাজ সম্পদ বা নোবেল অ্যাসেট এই ধর্মে পরিত্যাজ্য। স্বর্ণ সবসময়ই রাজ ধাতু। স্বর্ণ এমনকি সোনালী রঙ তাই ধর্মীয় স্থানে অনুৎসাহীত। আর ইসলাম ধর্মকে আপনি সত্যিকারভাবে যদি ধরতে না পারেন, তাহলে ডোম অফ দ্য রক বা কুব্বাত আস সাখরার স্বর্ণের পাত লাগানো গম্বুজকে আল আকসা মসজিদ মনে করে নিজেদের মসজিদও সোনালী গম্বুজের বানিয়ে ফেলতে পারেন।
নবী মুহম্মদ এটা জানতেন যে একসময় তার উম্মতেরা এটা করবে। সেই কারণে তিনি কোরআন লিখিয়ে যাননি, হাদিস পুড়িয়ে ফেলতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। একই আল্লাহর তিনটি ধর্ম হলেও কোর’আনে রাজা মহারাজাদের বিবরণ নেই, নেই তাদের বৈভব প্রতিপত্তির কথা।