নিঝুম দ্বীপ গেছি একটি গবেষণা দলের সাথে। সেখানে আমরা উঠেছি একটি প্রাইভেট রেষ্টহাউজে। সাধারণত সরকারী বেসরকারী রেষ্টহাউজে আমরা উঠলে কেয়ারটেকার যে থাকে, সে রান্না বান্না করে অথবা সে তার বাসা থেকে রান্না করে নিয়ে আসে। নিঝুম দ্বীপ এক কেয়ারটেকারের কথা শুনলাম যার স্ত্রী খুব ভাল রান্না করে। গেস্টরা একবার তার খাবার খেয়ে খুব প্রসংশা করেছে এই বলে যে "তোমার বৌ তো খুব ভাল রান্না করে"! সেই প্রশংসা শুনে সেই কেয়ারটেকার উত্তর দিয়েছিল “হ স্যার, রান্না ভাল না করতে পারলে কবে তালাক দিয়া দিতাম”।
উক্ত কেয়ারটেকারের কথা শুনে সবাই কৌতুক বোধ করেছে নিশ্চই। রান্না ভাল না করতে পারলে সে বৌকে তালাক দিয়ে দিতে চাইলে সেটা তার অধিকারও বটে তবে রান্না ভাল না করতে পারলে সে যদি বৌকে ধরে প্রহার করত বা তাকে বন্দি করে রাখত বা তাকে গুম করে ফেলত, তাহলে কি সেটা তার অধিকারের মধ্যে পড়ত? তখন কি সেটাকে হাসি ঠাট্টা হিসাবে নেওয়া চলত? সেটা নিলে সেটাকে আইনের ভাষায় বলা হয় বাইস্ট্যান্ডার, যেটা অনেক ক্রিমিনাল আইনেই অপরাধের সামিল।
আমেরিকা যখন আমাদের দেশে গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে অনেকেই বলতে চায় আমেরিকায় গণতন্ত্র আছে কিনা বা তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করে কিনা। অনেকে ভাবে আমেরিকা মনে হয় একটি গণতান্ত্রিক দেশ। আসলে ধারনাটা ভুল। গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটি অনেকটাই অস্পষ্ট একটি বিষয়। এর ফলে গণতন্ত্রের নামে অনেক কিছুকেই চালিয়ে দেওয়া যায়। বেশিরভাগ স্বৈরতান্ত্রিকেরা ভাবে তারা আদর্শ গণতন্ত্র অনুশিলন করছে। আমেরিকা ধনতান্ত্রিক দেশ, সেখানেও গণতন্ত্র আসলে নামে। গণতন্ত্র আর ধনতন্ত্র কি একসাথে যায়? রাষ্ট্রপরিচালনায় আমেরিকাতে একজন হোমলেস আর একজন বিলিয়নিয়ারের অধিকার কি এক? আমেরিকাতে গণতন্ত্র আসলে একটি ফল (effect) যার কারনটি (cause) হল আইন দ্বারা নিশ্চিত নুন্যতম অধিকারের নিশ্চয়তা। সেটি তারা সারা বিশ্বের জনগনের জন্যও চায়।
আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্টিন গিলেন্স এবং বেঞ্জামিন আই. পেজের একটি সাম্প্রতিক (২০১৪) গবেষণা বলছে যে আমেরিকার সাধারণ মানুষ যদি কোনো নীতি পরিবর্তন (পলিসি চেঞ্জ) চায় (বা কোন নীতির বিরোধিতা করে) তাহলে শতভাগ সাধারণ মানুষ সেটা চাইলেও সেটার জন্য নীতি পরিবর্তন হয়ে থাকে শতকরা মাত্র ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে। যখন আরো কম মানুষ সেটা চায় তখন ফলটা আরো কমে আসে। আবার যখন সামান্য সংখ্যক অর্থনৈতিক এলিটেরা কোন নীতি পরিবর্তন চায়, তখন মাত্র ৪০ শতাংশ মানুষ সেটা চাইলেও ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে নীতি পরিবর্তন হয় এবং ৯০ শতাংশ চাইলে সেটা ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হয়। এটিই শেষ নয়, যখন কোন ইন্টারেস্ট গ্রুপেরা কাজ করে (যেমন লবিস্ট গ্রুপ), তখন তারা আবার নীতি পরিবর্তনকে শতকরা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত প্রভাবিক করতে পারে। এর অর্থ হল, এলিট গ্রুপ ও ইন্টারেস্ট গ্রুপ একসাথে যখন মিলে তখন নীতি পরিবর্তিত হয় খুব সহজে এবং স্বল্প সংখ্যকের ইচ্ছায়, যেটা কোনভাবেই গণতন্ত্র নয়। (গবেষনাটির ফলের ছবি দেখুন কমেন্টে)।
কিন্তু তাহলে গণতন্ত্র না হলে আমেরিকা কি রক্ষা করতে চায়? আমেরিকানদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ কি? সেটা বুঝতে গেলে আমাদের আমেরিকার ইতিহাসের দিকে একটু তাকাতে হবে। স্বাধীনতার জন্য আমেরিকা একটা যুদ্ধ করেনি, দু-দুটো যুদ্ধ করেছে, একটা বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে আর একটা দেশি ভাইদের বিরুদ্ধে যারা সেই বিদেশী মানসিকতা ধারণ করেছিল।
আমেরিকার জনগণ তাদের মাটিতে যে দুটো যুদ্ধ করেছে, সেই দুটোই মানুষের নুন্যতম অধিকার আদায়ের জন্য। প্রথমটি বৃটিশ ব্যবসায়ীদের স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ পার্লামেন্টের দ্বারা আমেরিকায় (বৃটিশ কলোনিগুলোতে) ইচ্ছামত আইন কানুন প্রণয়নের ক্ষমতার বিরুদ্ধে। ১৭৬৬ সালে ব্রিটেনের কর্তৃপক্ষ একটি আইন জারি করা যার নাম ঘোষণামূলক আইন (Declaratory Act)। আইনটা হল, তখন থেকে উপনিবেশবাসীদের সব অধিকার ঠিক করবে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, স্থানীয় গভর্নর নয়। এই আইন অনুযায়ী উপনিবেশবাসীদের ওপর একে একে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ ও অবদমনমূলক নতুন আইন ও কর চাপানাে শুরু হলে আমেরিকার জনগণ বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘােষণা করে। ১৭৮৩ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে ও আমেরিকা স্বাধীন হয়।
স্বাধীনতার পর ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পেয়ে আমেরিকা খুব দ্রুত উন্নতি লাভ করে। তবে মানুষের স্বাধীনতা, জীবনযাপন ও সম্পদের বণ্টনে রয়ে যায় চরম অসমতা। এই অসমতা চরম ছিল উত্তর ও দক্ষিন অঞ্চলের ভেতর। ১৮৫০ এর আগে আমেরিকার দক্ষিনের রাজ্যগুলো ছিল অধিক ধনী ও সমৃদ্ধ। কিন্তু সেই অর্থনৈতিক শক্তির উৎস ছিল উপনিবেশবাদীদের ফেলে যাওয়া কৃষি উৎপাদন, চিনিকল ও দাসপ্রথা নির্ভর অর্থনীতি। ১৮৫০ এর পর থেকে আমেরিকার উত্তর অঞ্চলের রাজ্যগুলোতে নানা খনিজ সম্পদ পাওয়া যেতে থাকে এবং আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর নব্য কল কারখানা ও শিল্প ব্যবসার বিকাশ ঘটতে থাকে। এর ফলে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের উদ্ভব ঘটে, শিল্প সাহিত্য, বিজ্ঞান ভিত্তিক অধকার, নৈতিকতা ও মানবিকতার উন্মেষ ঘটে। আমেরিকার উত্তরের রাজ্যগুলো পুরো আমেরিকাব্যপী ফেডারেল আইন কানুন, যার মাধ্যমে সেখানে দাসপ্রথা তুলে দিয়ে মানুষের ন্যুন্যতম অধিকার বলবৎ থাকবে এমন দাবী উত্থাপন করতে থাকে।
অপরদিকে দক্ষিনের ১১টি রাজ্যে, যেখানে বেশিরভাগ মানুষ শ্রমিক ও বাকিটা সংখ্যালঘু সামন্ততান্ত্রিক ভুমি মালিক, তারা একটি কনফিডারেট গঠন করে যারা যারা চায় দাসপ্রথা বলবৎ থাকুক। এই সময় স্টিফেন এ ডগলাস নামে ইলিনয়ের এক সিনেটর ১৮৫৪ সাল একটি বিল উত্থাপন করেন যেটি ক্যানসাস নেব্রাসকা বিল হিসেবে পরিচিত। এই ক্যানসাস নেব্রাসকা বিল পশ্চিমে নতুন দুটি রাজ্য গঠনের প্রস্তাব দেয় এবং বলে যে নতুন এই রাজ্য দুটিতে রাজ্য দুটো নিজেরাই নির্ধারণ করবে যে সেখানে দাসপ্রথা থাকবে কি থাকবে না। এটি নির্ধারণে ফেডারেল সরকারের কোনো ভূমিকা থাকবে না এবং এই ধারণাটি পপুলার সভারেনটি বিল হিসেবে বহুল পরিচিত। বিলটি ৩৭/১৪ ভোটে সিনেটে এবং ১১৩/১০০ ভোটে হাউজে পাশ হয়ে যায়।
ক্যানসাস নেব্রাসকা বিল পাশ হলে এতে প্রচন্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে উত্তরের রাজ্যগুলো। উত্তরের তীব্র প্রতিরোধের মধ্যই বিলটিকে আইন হিসেবে অনুমোদন দিয়ে দেন তখনকার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন পিয়ার্স। পাস হয়ে গেল ঘটনাবহুল ক্যানসাস নেব্রাসকা অ্যাক্ট। এর ফলেই শুরু হলো আমেরিকার গৃহযুদ্ধ যেটা চলে ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ পর্যন্ত। এই চার বছরব্যাপী এই যুদ্ধে ৬০০,০০০ এর বেশি বেশি সৈন্য মারা যায় এবং দক্ষিণের বেশীরভাগ স্থাপনা ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। কনফেডারেসি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয় এবং নতুন আমেরিকায় গ্রণতন্ত্রের উপরে স্থান পায় মানুষের মৈলিক অধিকারসমূহ। কারন তারা দেখেছে সমাজে চরম আর্থিক ও শিক্ষাগত অসমতা থাকলে গণতন্ত্রও দাসপ্রথায় পরিণত হয়। আমেরিকা যদি পুরো গণতন্ত্রের দেশ হত তাহলে পপুলার সভারেনটির (গণমতের মাধ্যমে স্বাধীনতা) বিপক্ষে এত প্রচন্ড বিক্ষোভ হত না।
১৯১৪ সালে শুরু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৩৯ সালে শুরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দুটোই শুরু হয় কিছু দেশের একনায়ক সরকারব্যবস্থা ও ঐ সব দেশের সরকারগুলোর ভিন্ন রাষ্ট্র বা উপনিবেশে দাসপ্রথা সহ স্বেচ্ছাচারী আচরণের কারনে যারা গণতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে যায়। এই দুটো বিশ্বযুদ্ধে, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সংশ্লিষ্ট উন্নত রাষ্ট্রসমূহের এত ক্ষয় ক্ষতি ও ভোগান্তি হয় যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীতে অনেক উপনিবেশিক দেশ উপনিবেশকতা থেকে বের হয়ে আসে। এর ফলে অনেক দেশ স্বাধীন হয় (আমরা সহ) এবং ভবিষ্যত বিশ্বযুদ্ধ থেকে রেহায় পেতে একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সংস্থা তৈরী করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় যাতে রাষ্ট্রগুলোতে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার বজায় থাকবে এবং যেটা স্বৈরতন্ত্রকে জনপ্রিয় হতে বাধা দেবে।
প্রথমে বলা গল্পে উক্ত কেয়ারটেকারের কথা শুনে সবাই সেটাকে হাস্যরস হিসাবে নিয়েছিল। কিন্তু আরো নিকট সামাজিকতার বলয়ে কোন সদস্য, যেমন অফিসের কলিগ, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বা ব্যক্তিগত কর্মচারীরা যদি গুরুত্বপূর্ণ কোন মূল্যবোধ ভঙ্গ করে, যেমন কাজের মেয়ে, স্ত্রী বা নারী-শিশু নির্যাতন করে অথবা শিশুদের যৌন উত্যক্ত করে - তখন আপনি কি করবেন? সেটি তার ব্যক্তিগত বিষয় বা সেটি তার বাড়ির অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে এড়িয়ে যাবেন? নাকি এগুলোর বিরুদ্ধে সামাজিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন?
সকল ব্যক্তিগত বিষয় ব্যক্তিগত বা অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, যদি সেটা আমরা যে মূল্যবোধকে অতি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি তার সাথে সাংঘর্ষিক হয়। বংলাদেশে বর্তমান যে শাসন চলছে সেটা আধুনিক আমেরিকা রাষ্ট্রের যে প্রাথমিক মূল্যবোধ এবং জাতীসংঘ সনদের যে প্রাথমিক শর্ত, তার সাথে চরম সাংঘর্ষিক। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা এই কারনেই।