ক্রিকেটার তানজিম হাসান সাকিব বিসিবির কাছে বলেছেন “আমি নারী বিদ্বেষী না, আমার মা -ই তো একজন নারী”। এটা একটি অর্থহীন উক্তি (ফলস স্টেটমেন্ট) কারণ সকল মানুষের মা-ই নারী। যারা নারীবিদ্বেষি তাদের মায়েরা পুরুষ নয় বা তারা এলিয়েন মায়ের সন্তান নয়। তাহলে এই বক্তব্য প্রমাণ করছে বিশ বছর বয়সের এই ক্রিকেটারের প্রাথমিক যুক্তিজ্ঞানের বোধ সংক্রান্ত সমস্যা আছে। ক্রিকেটার তানজিম হাসান সাকিবকে সমর্থন করা লক্ষ লক্ষ সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরও প্রাথমিক যুক্তিজ্ঞানের বোধ সংক্রান্ত একই সমস্যা আছে। এলকাইন্ডের বয়ঃসন্ধিকালে ৬টি অপরিণত চিন্তার ‘সিদ্ধান্তহীনতা’ ও ‘আপাত কপটতা’ এর জন্য দায়ী (মনোবিজ্ঞানী এলকাইন্ডের বয়ঃসন্ধিকালে ৬টি অপরিণত চিন্তার বিবরণ আগের পর্বে আছে)। তার মা নারী এই সরল যুক্তি প্রয়োগ করে সে যে নারী বিদ্বেষী নয় সেটা প্রমাণ করতে চাইছে। তানজিমের উদ্দেশে ক্রিকেটার মিরাজের বার্তাটিও তাই। বাংলাদেশের সংবিধান ৩৯ ও ৪১ অনুচ্ছেদের যে দোহাই মিরাজ দিয়েছে সেটিও সে এলকাইন্ডের ‘আপাত কপটতা’ ও নিজ ‘আদর্শবাদ ও অতি সমালোচনার মানসিকতা’ থেকে দিয়েছে।
কেন এই বয়ঃসন্ধী পার হওয়া তরুণেরা তাদের বয়ঃসন্ধিকালে অপরিণত চিন্তার প্রকাশ ঘটাচ্ছে? খেয়াল করলে দেখা যাবে এই তরুণ ক্রিকেটাররা বেশিরভাগই গ্রামাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া সমাজ ও নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে এসেছে। জাতীয় দলের লাইমলাইটে এসে এদের অবস্থা অনেকটা গ্রামের নালার পুঁটি মাছের মহাসাগরের পানিতে পড়ার মত। রাতারাতি আধুনিক শহুরে সমাজের হিরো হয়ে যাবার কারনে তারা যে বিপুল শক্তির অধিকারী এবং তার ফলে লোভ, প্রবৃত্তি ও যৌনতার যে প্রবল হাতছানী, সেগুলোকে কিভাবে মোকাবেলা করবে সেগুলো তাদের জানা হয়ে ওঠেনি। এর ফলে তারা যেন আর সামনে এগুতো চায় না। বয়ঃসন্ধিকালে অপরিণত চিন্তার ভেতরেই যেন নিজেদের আবদ্ধ রাখাকে নিরাপদ মনে করছে। এর জন্য ধর্ম প্রচারকারীদের তারা পথপ্রদর্শক হিসাবে বেছে নিয়েছে।
খেয়াল করলে দেখা যাবে বাংলাদেশে যারা ধর্ম প্রচার করে, ওয়াজ মাহফিল, ধর্মীয় পুস্তকাদি এমনকি জুম্মার খুতবাগুলো শুনলে এটা পরিষ্কার হয় যে বেশিরভাগ বক্তার মধ্যেই এলকাইন্ডের বয়ঃসন্ধিকালে ৬টি অপরিণত চিন্তা প্রকটভাবে বিদ্যমান। এই সব ধর্ম প্রচারকদের অবস্থা এই ক্রিকেটারদের মতই। গ্রামাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া সমাজ ও নিম্ন আয়ের সহজ সরল জীবনে বড় হয়ে লোভ, প্রবৃত্তি ও যৌনতার প্রবল হাতছানীর প্রবল অর্থশক্তি চালিত শহুরে জীবনকে ঘায়েল করার একমাত্র অস্ত্র তারা ভেবে নিয়েছেন এলকাইন্ডের বয়ঃসন্ধিকালে অপরিণত চিন্তাগুলোর প্রয়োগ। এই সব ধর্ম প্রচারকদের মধ্য দেখা যায় ‘আদর্শবাদ ও অতি সমালোচনার মানসিকতা’, মানুষেকে কল্যাণ ও প্রশান্তির পথ দেখানোর চেয়ে ঢের বেশী উৎসাহী তারা নারী ও অন্য ধর্মের সমালোচনায়। তাঁদের মধ্য দেখা যায় অসম্ভব ‘তর্কপ্রবণতা’, বোধ নয়, তর্কে জিতলেই যেন ধর্ম রক্ষা হবে। দেখা যায় জটিল বিষয়ে ‘সিদ্ধান্তহীনতা’, তাই তারা বিপদে মানুষের কি করা উচিৎ সেই উপদেশ না দিয়ে কোন মহামানব কি করতেন সেটার বয়ানে বেশি পারদর্শী। তাঁদের মধ্য দেখা যায় ‘আপাত কপটতা’, যারা নিজেদের আদর্শ জাতী কল্পনা করে, কিন্তু তাদের নিজেদের জীবন ঘুষ. দুর্নীতি, সস্তা আবেগ ও প্রবৃত্তির নিকষ কালো গুহায় ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে। তাঁদের ‘আত্ম-চেতনা’ প্রকট, তাঁরা মনে করেন মহানবীর পরেই তাদের অবস্থান এবং দ্রতই তারা দুনিয়া শাসন করবেন অথচ তারা অতি দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশের খুবই পিছিয়ে পড়া এক পেশাজীবি যাদের আসলে কেউই পাত্তা দেয় না। এবং তাঁরা মনে করেন তাদের আছে ‘অসাধারনত্ব’ ও তারা ‘অভেদ্য’, অবচেতনে তাঁরা মনে করেন তাঁরা সুপারম্যান বা ওয়ান্ডারওম্যানের মতো যারা একদিন সারা দুনিয়ায় দ্বীন প্রতিষ্ঠা করবেন। তাঁরা মনে করেন তাঁরা সকল বিপদ ও পরিনতির ঊর্দ্ধে তাই সহজেই সন্ত্রাসবাদের সমর্থক হয়ে যান এবং ‘কল্পিত দর্শকের ধারণা এবং ব্যক্তিগত উপকথা’ বিশ্বাস করে মনে করেন বিজয় আসন্ন অথচ প্রকৃত অর্থে ধর্ম বিদায় নিচ্ছে।
সনাতন হান্টার গ্যাদারার মানব সমাজে বয়ঃসন্ধিকালে যৌনতা কখনই ভীতির কারণ ছিল না। এর কারণ হল তখন মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে তেমন কিছু ছিল না। ধন সম্পদও ছিল না। আদিম সমাজে যৌনতা অনেকটা প্রকৃতির নিয়মেই চালিত হত। এখনও পৃথিবীর বেশিরভাগ বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠিতে নারীর স্তনকে যৌন অঙ্গ হিসাবে দেখা হয় না। তাই নারীর বক্ষ উন্মুক্ত রাখা না রাখায় সেখানে কিছু যায় আসে না। মানুষ কৃষি সভ্যতায় প্রবেশের পর থেকে জমির ব্যক্তিমালিকানার প্রচলন শুরু হয়। পিতার মৃত্যুর পর সন্তান হয় সেই জমির মালিক। সন্তান পিতার ঔরসজাত কিনা এটা নিশ্চিত করতেই যৌনতায় নিয়ন্ত্রণ আসা শুরু হয় যেটা নারীর প্রতি প্রয়োগ হতে থাকে। কিশোর কিশোরীদের বয়ঃসন্ধীকালে যৌনতা থেকে দুরে রাখতে ‘যৌনতা মন্দ’ এই মূল্যবোধ প্রকট হতে থাকে এবং বহু ধর্ম আসলে বিকাশ লাভ করে যৌন প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়ইয়ের লক্ষ্যেই।
পুরুষ এবং পুরুষের পরিবার সবসময় ভীত থাকত যে স্ত্রীর সন্তান যদি স্বামীর ঔরসজাত না হয় তাহলে তার সম্পত্তি চলে যাবে অন্য গোষ্ঠীর সদস্যের হাতে। সম্পত্তি হারানোর এই ভয় থেকেই শুরু হয় নারীকে ঘরে বন্দি রাখা ও বোরকা বাক্সে আবদ্ধ রেখে শুধু সন্তান উৎপাদন ও লালন পালনের যন্ত্র হিসাবে ব্যবহারের সামাজিক মূল্যবোধ। নারীও এই মূল্যবোধের উৎসাহী সমর্থক হয়ে ওঠে কারণ সমাজে ধন সম্পদ ও বিবাহ প্রথার ব্যপক বিস্তার ঘটলে নারী ভীত হয়ে ওঠে যে অন্য নারীর যৌন আকর্ষণে তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যাবে। পুরুষ এবং পুরুষের পরিবার এই ভয় থেকে যৌনতা মন্দ এই মূল্যবোধের প্রচার প্রসারও শুরু হয়।
যৌনতা মন্দ এই মূল্যবোধ বয়ঃসন্ধিকালের ৬টি অপরিণত চিন্তায় ব্যপক প্রভাব ভেলতে শুরু করে। একদিকে যৌনতা প্রচন্ড আগ্রহের বিষয় এবং তার সাথে এমন শারীরিক সুখ ও মনের আনন্দ উদ্দিপনা জড়িত যেটা অভূতপূর্ব। অপর দিকে সামাজিক মূল্যবোধে যৌনতা মন্দ এবং পাপ। এই উভয়সঙ্কটে বয়ঃসন্ধিকালে শিশু কিশোরেরা বিভ্রান্ত হয়ে যায়। তাদের মধ্য যেহেতু ‘আপাত কপটতা’ বিদ্যমান, তাই প্রকৃতির তাড়নায় তাদের মধ্যে যারা যত বেশি যৌন উৎসাহ ও যৌন চিন্তায় রত হয়, তারা তত বেশী আদর্শবাদী হয়ে একটা ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করে। ফেসবুকে দেখা যায় যে সকল কিশোর যত ধর্মবানী ও ধর্ম নিয়ে অন্যকে আক্রমণে রত, তারা তত বেশি পর্ন বা সফট পর্ন পেজগুলোতে যুক্ত।
কিন্তু কিশোর বয়সে যৌনতা নিয়ে যত বিভ্রান্তীই থাক না কেন, যৌনতা এতই শক্তিশালী যে, সে তার জীবনকে এর থেকে বিযুক্ত রাখতে পারে না। কৈশোর পার হবার আগেই সে কিভাবে এই মহা শক্তির সাথে মোকাবেলা করবে ও এর মাধ্যমে নিজের জীবনকে সূুখ ও আনন্দে পরিপূর্ণ করবে তার রূপরেখা তৈরী করে ফেলে। কিন্তু কিছু মানুষ পারে না সেই বয়ঃসন্ধিকালের বিভ্রান্তী হতে বের হতে। এটি বুঝতে গেলে একটু নিউরোসায়েন্স বুঝতে হবে। পরের পর্বে থাকবে জন ম্যাকলিয়ানের ট্রিউন ব্রেইন তত্ত্ব যার মাধ্যমে আমরা বুঝব পরিণত মন কিভাবে তৈরী হয়।