বর্তমান দুনিয়ায় মানুষ কি চায়? মানুষের স্বপ্নগুলো কেমন? আপনার সন্তানকে আপনি কখন সফল বলবেন? বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে প্রথাগত শিক্ষায় সন্তান যখন সফল হবে এবং যখন সে যথেষ্ট অর্থ উপায় করবে এ দুটোকেই সফলতা মনে করা হয়। এর অর্থ কেউ যদি কোন বিষয়ে নোবেল পুরষ্কার পায় বা সে যদি একজন বিলিয়নিয়ার হয় - তাহলে সেগুলোই বর্তমান যুগের মানুষদের চুড়ান্ত সফলতা বা ভবিষ্যত নিয়ে স্বপ্ন। সেই হিসাবে ইহুদিরা কিন্তু দুনিয়ায় সেরা।
১৯০১ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত মোট নোবেল পুরষ্কার বিজয়ীর সংখ্যা ৯৬৫, তার মধ্যে পিতা বা মাতা অন্তত একজন ইহুদি এমন মানুষদের নোবেল পুরষ্কার পাবার সংখ্যা হচ্ছে ২১৪ জন বা শতকরা ২২। যেখানে দুনিয়াতে ইহুদিদের সংখ্যা মাত্র ০.২%। এর অর্থ ইহুদিরা অন্যদের চেয়ে নোবেল জয়ে ১১০ গুন এগিয়ে।
অপরদিকে খ্যাতনামা ফোর্বস পত্রিকার হিসাবে বিশ্বের ৫০ জন শীর্ষ বিলিয়নিয়ারের মধ্যে ১০ জন ইহুদি যেটা শতকরা হিসাবে ২০। যার অর্থ একইভাবে ইহুদিরা অন্যদের চেয়ে অর্থ উপার্জনে ১০০ গুন এগিয়ে।
কেন ইহুদিরা বিনিময়যোগ্য জ্ঞান (সকল জ্ঞানে নয়) ও ব্যবসায় এতটা সফল? ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী শিমন পেরেজ একবার বলেছিলেন: "আমাদের ডিএনএতে এমন কিছু আছে যাতে আমরা, ইহুদিরা কখনও কোন কিছুতে সন্তুষ্ট বোধ করি না।"
নানা গবেষণায় এটা দেখা গেছে যে ইহুদিদের ডিএনএ বাকি দুনিয়ার মানুষ থেকে আলাদা নয়। কিন্তু তারা আচরণগতভাবে কেমন ব্যক্তিত্বের সেটা শেক্সপিয়ার লিখে গেছেন ৪২৫ বছর আগে:
“ষোড়শ শতাব্দীতে উইলিয়াম শেক্সপিয়র রচিত জনপ্রিয় কমেডি নাটক দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিসে ইতালির ভেনিস শহরে বাস করে ব্যবসায়ী অ্যান্টনিও। সকলের কাছে সে ভাল মানুষ হিসাবে প্রশংসিত। আর এক ব্যবসায়ী শাইলক যে ইহুদি এবং চারিত্রিকভাবে নীতিহীন, সুদখোর, কুটবুদ্ধিসম্পন্ন। কেউই তাকে পছন্দ করেনা। সে অ্যান্টিনিওকে হিংসা করত এবং সংগত কারণেই অ্যান্টনিও তাকে দেখতে পারত না। অ্যান্টানিওর ঘনিষ্ট বন্ধু বাসানিও টাকার অভাবে তার প্রেমিকা পোর্শিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারছে না।
অবশেষে অ্যান্টনিও বন্ধুর মনোবাসনা পূরণ করতে শাইলকের কাছে টাকা ধার করে। তবে শর্ত থাকে যদি অ্যান্টিনিও সময়মতো টাকা পরিশোধ করতে না পারে তবে অ্যান্টিনিওর দেহ থেকে এক পাউন্ড মাংস কেটে দিতে হবে। টাকা পাওয়ার পর একটি বিচিত্র পরীক্ষায় সফল হয়ে বাসানিও পোর্শিয়াকে বিয়ে করে। টাকা প্রদানের সময়সীমা পার হয়ে যাবার পরও টাকা না পেয়ে শাইলক অ্যান্টিনিওর শরীর থেকে এক পাউন্ড মাংস দাবী করে। বিচারক অনুরোধ করলেও শাইলক তার অনমনীয়তা বজায় রাখে।
খবরটা পোর্শিয়াকে বিচলিত করে এবং যখন অ্যান্টিনিওর বিচারকার্য চলছে, তখন এক তরুন উকিলের ছদ্মবেশে পোর্শিয়া বিচারকের সামনে দাঁড়ায়। তরুণ উকিল শাইলককে অ্যান্টিনিওর শরীর থেকে এক পাউন্ড মাংস কেটে নিতে বলে কিন্তু রক্তপাতহীনভাবে কারণ রক্তপাতের কথা দলিলে উল্লেখ ছিলনা। রক্তপাতহীন মাংস কাঁটা অসম্ভব। ধূর্ত শাইলক বিপদে পড়ে যায় এবং অবশেষে বিচারে সে হেরে যায়।”
আপনি যদি জ্ঞানী হয় এবং কোমল ও সংবেদনশীল হৃদয়ের হন, আপনি ব্যবসায় তেমন সফল হতে পারবেন না। আপনাকে চালাক বা উইটি হতে হবে এবং লাজ লজ্জাহীন চশমখোর হতে হবে, সেটা না হলে বিলিয়নিয়ার হতে পারবেন না। অপরদিকে জ্ঞান অর্জনেরও শ্রেণীবিভাগ আছে। এপিস্টেমোলজি বা জ্ঞানতত্ত্ব অনুসারে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয় এমন সব জ্ঞানই যেটা বিনিময়যোগ্য বা প্রমাণযোগ্য জ্ঞান।
আপনি যদি সংবেদনশীল মানুষ হন, বর্তমান দুনিয়ার ঘটনাগুলো আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলবে। এত আধুনিক, এতটা এগিয়ে যাওয়া একটা দুনিয়াতে, জলা জঙ্গলে ঢাকা পিছিয়ে পড় আফ্রিকা নয়, খোদ ইউরোপে-মধ্যপ্রাচ্যে, যেসব দেশ নিজেদের সভ্য বলে দাবী করে তারা বোমা দিয়ে দুরমুজ করে কংক্রিটের চাপে পিষে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারছে কেন? ইউক্রেন যুদ্ধে এর মধ্যেই মারা গেছে পাঁচ লাখের উপর, ইসরায়েল ফিলিস্তিনে এক মাসেই দশ হাজারের বেশি যার মধ্যে বেশিরভাগই শিশু।
একসময় একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক গবেষণা হয়েছিল যে ইহুদিরা এমন কেন? একদিকে তারা বিনিময়যোগ্য জ্ঞানে, অর্থাৎ বিজ্ঞানে, গণিতে, অর্থনীতিতে, প্রকৌশলে অন্যদের চেয়ে শতগুন সেরা। অপরদিকে ব্যবসায় অন্যদের চেয়ে শতগুন সেরা অথচ তাদের কেউ পছন্দ করে না। কেউ তাদের প্রতিবেশী হিসাবে মেনে নেয় না, তাদের দ্বারা শাসিত হতে চায় না, তাদের বিশ্বাস করে না। তাদের দেশছাড়া করতে চায়, এটা কেন?
১৯২৬ সালে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট এজরা পার্ক প্রথম উদ্ভাবন করেছিলেন "মার্জিনাল ম্যান" ধারণাটি যেটি দ্বারা দুটি ভিন্ন জাতি বা সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ব্যক্তিকে বর্ণনা করা হয়। পার্কের মতে:
“মার্জিনাল ম্যান… এমন একজন যাকে ভাগ্য পরিহাস করছে দুটি সমাজ-সংস্কৃতি ধারণ করে বসবাস করতে এবং যেদুটি শুধু ভিন্ন নয় বরং সেগুলো পরস্পরবিরোধী সমাজ-সংস্কৃতি…। মার্জিনাল ম্যানের মন হল সেই জ্বলন্ত ক্রুসিবল যেখানে দুটি ভিন্ন এবং অবাধ্য সংস্কৃতিকে গলিয়ে একিভূত করতে বলা হয় এবং হয় এবং যেগুলো সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে মিশে যায়”।
এজরা পার্ক এই দুটি সমাজ-সংস্কৃতি ধারণ করে বসবাস করা "মার্জিনাল ম্যান" বলতে বুঝিয়েছেন প্রবাসী বা মাইগ্র্যান্টদের যারা নিজের সংস্কৃতি এবং একটি অসংগত বিরোধী সংস্কৃতিকে একই সাথে ধারণ করে বাস করার চেষ্টা করে।
ইহুদিরা ঐতিহাসিকভাবে মাইগ্র্যান্ট অপরদিকে আমেরিকানরা আড়াই’শ বছরের মাইগ্র্যান্ট। মাইগ্র্যান্টরা নেতৃত্বে চলে গেলে অসুরের রাজত্ব তৈরী হয়। যার ফল বর্তমান দুনিয়ার বিপর্যয়।
এই "মার্জিনাল ম্যান" ঘটনার একটা দেশীয় সংস্করণ আমরা বর্তমানের বিসিএস জেনারেশনের মাধ্যমে দেখছি। সেরা বিসিএসদের বেশীরভাগ স্থানীয় অভিবাসী বা লোকাল মাইগ্র্যান্ট। এদের হাতে দেশের ক্ষমতা চলে যাবার পর আমরা দেখছি দেশ “উন্নত” হচ্ছে কিন্তু দেশ থেকে উঠে যাচ্ছে বিবেক, বিবেচনা, দয়া, ভালবাসা, বিশ্বাস ও ন্যায় বিচার, এমনকি প্রকৃত অর্থে ধর্মও।
শিমন পেরেজের ভাষায় বললে আমাদের বর্তমানের বিসিএস এবং সফল ব্যবসায়ী রাজনীতিবীদ ও সামরিক বেসামরিক সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যেও এমন কিছু আছে যাতে তারা ইহুদিদের মত কখনও কোন কিছুতে সন্তুষ্ট বোধ করে না। তাই তারা সেরা হয়েছে। জাতীগত সংস্কৃতি উপেক্ষা করে শুধু 'মেধা' বিচার করলে মার্জিনাল ম্যানরাই নেতৃত্বে উঠে যাবে।
এই মার্জিনাল ম্যানদের মন কিন্তু সেই জ্বলন্ত ক্রুসিবল এজরা পার্ক যেমনটি বলেছেন। সফল হয়েও এই জ্বলন্ত ক্রুসিবল থেকে তারা আবার পালাতে চায়। তাই তারা আবার মাইগ্র্যান্ট হবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। খেয়াল করে দেখেন যারা এদেশে সফল তারা প্রায় সকলেই চাকুরি ব্যবসা শেষ করে বিদেশে চলে যেতে চায়। চুরি করে হোক বা না করে তারা নিজেদের ছেলে মেয়েদের বিদেশে পাঠিয়ে তাদের অনেকে এর মধ্যেই মাইগ্র্যান্ট করে ফেলেছে। তাদের ঘাড়ে ভর দিয়ে তারা নিজেরা এবার মাইগ্র্যান্ট হতে চায়। গবেষণা বলছে মাইগ্র্যান্টদের মধ্যে তৃতীয় প্রজন্মের পর থেকে সেই জলন্ত ক্রুসিবল অবস্থা চরমে পৌছায়। ধর্মগ্রন্থগুলো বলছে এর পর শহরগুলো নরককুন্ডে পরিণত হয় এবং সেগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
