এই বছরই মে মাসে আমেরিকার একটি সংবাদ দ্রুত বিশ্বসংবাদে পরিণত হয়। সংবাদটি ছিল: “মেক্সিকো সিটি, মে ১৭ (রয়টার্স) - মার্কিন বিচার বিভাগ প্রকাশ করেছে যে মার্কিন ডিইএ (ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) এর মাদকবিরোধী এজেন্টরা আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্তের নিচে স্থাপিত একটি মাদক-চোরাচালানের টানেল খুঁজে পেয়েছে যেটিতে রেল লাইন, বিদ্যুৎ সংযোগ এবং বায়ুচলাচলের জন্য ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা রয়েছে।
তথাকথিত নারকো টানেলটি মেক্সিকোর শহর টিজুয়ানা থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগোতে সীমান্ত থেকে ৩০০ ফুট দূরে একটি গুদাম ঘর পর্যন্ত গিয়েছে। মার্কিন কর্তৃপক্ষ মাদক চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য অপরাধের মধ্যে কোকেন, হেরোইন এবং মেথামফেটামিন বিতরণের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ রয়েছে।”
এমনই একটি টানেল যেটা মাদক ও মানবপাচারে ব্যবহৃত হত সেটির কাহিনী দিয়ে শুরু হয় ২০১৫ সালে কানাডিয়ান পরিচালক ডেনিস ভিলেনিউভ পরিচালিত একটি আমেরিকান অ্যাকশন থ্রিলার ছবি সিকারিও (Sicario)। ছবিটির কাহিনীচিত্র লিখেছেন টেলর শেরিডান এবং অভিনয় করেছেন এমিলি ব্লান্ট, বেনিসিও দেল তোরো, জোশ ব্রোলিন এবং অন্যান্যরা। ছবিটির নাম সিকারিও যেটি একটি স্প্যানিশ শব্দ যার অর্থ "হিটম্যান" - হিটম্যান হল যে লক্ষ্য নিশানা করে মানুষ হত্যা করে।
ছবিটি মাদক ও মানবপাচারের ঘটনা দিয়ে শুরু হলেও ছবিটি আসলে সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর সামরিকীকরণ এবং রাষ্ট্রের সংবিধান বহির্ভূত বিনা বিচারে মানুষ হত্যার মন্দ ফল তুলে ধরার প্রয়াসে। ছবিটির ঘটনা প্রবাহিত হয় একটি নৈতিক ও আইনগতভাবে সচেতন এফবিআই এজেন্টকে অনুসরণ করে যাকে একটি শক্তিশালী এবং নৃশংস মেক্সিকান ড্রাগ কার্টেলের নেতাকে ধরার জন্য একটি সরকারী টাস্ক ফোর্স দ্বারা নির্বাচিত করা হয়।
ছবিটির কাহিনী অনেকটা এরকম যে আমেরিকার অ্যারিজোনা রাজ্যের চ্যান্ডলারে, এফবিআই স্পেশাল এজেন্ট কেট ম্যাসার এবং রেগি ওয়েন একটি মাদক সংঘ সোনোরা কার্টেলের একটি সেফ হাউসে (গোপন আস্তানা) একটি অভিযানের নেতৃত্ব দেয় যেখানে তারা দেয়ালের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কয়েক ডজন নষ্ট হতে থাকা মৃতদেহ আবিষ্কার করে। অভিযানের সময়ই বাইরে একটি ফাঁদ পেতে রাখা বিস্ফোরকের (বুবি ট্র্যাপ) বিস্ফোরণে দুই পুলিশ অফিসার নিহত হয়। এই অভিযানের পরে এজেন্ট কেটকে সুপারিশ করা হয় পরবর্তি প্রক্রিয়ার দলে থাকতে যে দলটি সিআইএ অপারেটিভ ম্যাট গ্রেভার এবং গোপন সদস্য আলেহান্দ্রো গিলিকের তত্ত্বাবধানে একটি যৌথ টাস্ক ফোর্স। তাদের লক্ষ্য হল সোনোরা মাদক সংঘের দ্বিতীয় প্রধান ম্যানুয়েল দিয়াজকে গ্রেপ্তার করা।
যৌথ টাস্ক ফোর্স দলটি যার মধ্যে রয়েছে আমেরিকার ডেল্টা ফোর্স অপারেটরর্স, ইউএস মার্শাল এবং সিআইএ কর্মীরা। দিয়াজের ভাই গুইলারমোকে ধরে আনার জন্য মেক্সিকোর জুয়ারেজে প্রবেশ করে। এল পাসো-জুয়ারেজ সীমান্ত অতিক্রম করার সময়, দলটি কার্টেল হিটম্যানদের দ্বারা অ্যামবুশড হয় যাদের ডেল্টা ফোর্স দ্রুত হত্যা করে। বন্দুকযুদ্ধের সময়, কেট একজনকে হত্যা করতে বাধ্য হয় এবং সহিংসতার বিষয়টিতে দৃশ্যত সে বিরক্তি অস্বস্তি বোধ করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে, আলেহান্দ্রো গুইলারমোকে বন্দিশালার সেলের ভেতরে নির্যাতন করে এবং জানতে পারে যে কার্টেল মাদক পাচারের জন্য নোগালেস, সোনোরার কাছে একটি টানেল ব্যবহার করে। এদিকে কেট ম্যাটের মুখোমুখি হয়ে জানতে চায় যে এসব কি হচ্ছে? ম্যাট বলে যে আসল মিশন হল দিয়াজের ড্রাগ অপারেশনগুলিকে ব্যাহত করা যাতে সে তাদের তার বস, ড্রাগ লর্ড ফাউস্টো আলার্কনের সাথে যোগাযোগ করতে বাধ্য হয় যেটি তাদের ফাউস্টো আলার্কনের নিশানা দেবে। এটি জেনে যার পর নাই হতাশ হয়ে কেট তার তার এফবিআই সহকারী রেগিকে তাকে সহযোগীতার জন্য তার সাথে যোগ দিতে বলে।
যৌথ টাস্ক ফোর্স যখন জানতে পারে যে দিয়াজকে মেক্সিকোতে ফেরত পাঠানো হয়েছে, তখন তারা নোগালেসের কাছে টানেলে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নেয়। ম্যাট কেট এবং রেগিকে বলে যে তাদের জড়িত হওয়া একটি ওছিলা বা টেকনিক্যাল কারণ মাত্র কারণ সিআইএর মার্কিন সীমানার মধ্যে একা কাজ করার অনুমতি নেই। ক্ষুব্ধ রেগি কেটকে বলে যে তাদের চলে যাওয়া উচিত, কিন্তু কেট মিশনের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে মিশনে থাকার জন্য জোর দেয়।
টানেলে মাদক কার্টেলের সাথে বন্দুকযুদ্ধ শুরু হলে, কেট মেক্সিকোতে আলেহান্দ্রোকে অনুসরণ করে। সে আলেহান্দ্রোকে সিলভিওকে অপহরণ করতে দেখে। কেট আলেহান্দ্রোকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করে, কিন্তু বন্দুকের মুখে সিলভিওকে নিয়ে যাওয়ার আগে আলেহান্দ্রো কেটের কেভলার ভেস্টের উপর তাকে গুলি করে। মার্কিন সীমান্তের দিকে, কেট ম্যাটের মুখোমুখি হয়। ম্যাট ব্যাখ্যা করে যে মিশনটি কার্টেলগুলিকে একটি একক সত্তায় একীভূত করার একটি বিস্তৃত অপারেশনের অংশ মাত্র যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আরও সহজে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে।
পুরো ঘটনাটি এফবিআই এজেন্ট কেট এবং রেগিকে ক্ষুব্ধ করে কারণ তারা দেখছে এখানে দেশের আইন সংবিধান এবং তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি চরমভাবে লঙ্ঘিত ও উপেক্ষিত হচ্ছে। উচ্চতম রাজনৈতিক ও সামরিক সংযোগে থাকা কিছু ব্যক্তি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্বেচ্ছাচারিতা এবং নির্বুদ্ধিতার আশ্রয় নিচ্ছে শুধুমাত্র অস্ত্র ও ভায়োলেন্সের উপর নির্ভর করে।
এর ফল হচ্ছে দি নিউইয়র্কার ম্যাগাজিনে সিক্যারিওর রিভিউতে অ্যান্থনি লেন যেভাবে লিখেছেন, “That may be the most troubling side of “Sicario”: a growing awareness that the currency of life is being devalued”. অর্থ: "সিকারিও" এর সবচেয়ে সমস্যাজনক দিক হচ্ছে, একটি ক্রমবর্ধমান সচেতনতা যে, জীবন নামক মুদ্রার ক্রমিক অবমূল্যায়ন।
আপনি যদি আমাদের দেশের ক্রসফায়ারের ঘটনাগুলোর বর্ণনা পত্রিকার পাতায় নিয়মিত পড়ে থাকেন। আপনি যদি কিভাবে ঘটনাগুলো ঘটে সেটা মানষচক্ষে দেখার চেষ্টা করেন, আপনি পরিষ্কার বুঝতে পারবেন সব ঘটনার প্যাটার্নগুলো একই। তারা এমনই এক যে আপনি সিক্যারিও দেখলে আপনার মনে হবে যে এই ছবি আমেরিকায় নয়, এটি যেন টেকনাফের ঘটনা। যেখানে অদৃশ্য ক্ষমতা ও অদৃশ্য শক্তি জড়িত যেখানে কোন একজন দল ছেড়ে আসা অপরাধী দলের সদস্যের ক্ষমতা, যে এখন সোর্স, তার ক্ষমতা আইনসঙ্গত পুলিশের কর্মকর্তার চাইতে অনেক বেশি। এবং পুলিশ বাহিনী ঘটনা আইনসঙ্গত করার একটি মাধ্যম মাত্র।
সিকারিওর এই সংস্কৃতি চর্চার ফল হচ্ছে সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর সামরিকীকরণ। অস্ত্র, ট্রেনিং ও মানসিকতায় তারা এখন সেই অবস্থায় যেতে চায় যেখানে সাধারণ মানুষের জীবন নামক মুদ্রার কোন দাম নেই। আমেরিকার বিকারগ্রস্থ শাসকেরা ডিপ স্টেট প্রক্রিয়ায় অবৈধ উপায়ে নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে বা ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধিতে দেশের আইন ও সংবিধানকে পাশ কাটাতে পুলিশ বাহিনীর এই সামরিকীকরণের পথে হেঁটেছে। শুধু তাই নয় ভুরাজনীতির লক্ষ্যে তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল গণতন্ত্রের রাষ্ট্রগুলোতে নিজেদের সহায়ক সরকার বসিয়ে সেই সরকারগুলোর কাছে সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর সামরিকীকরণ রফতানি করেছে। এভাবেই বিএনপি সরকারকে সহযোগীতা করতে র্যাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আমেরিকার খুনি যুদ্ধাপরাধী প্রেসিডেন্ট বুশ ২০০১ সালে ৯/১১ ঘটনার পর যে প্যাট্রিয়ট আইন চালু করে তার মাধ্যমে চরমভাবে আমেরিকার জনগণের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুন্ন হয় এবং সহায়তা করে পুলিশ বাহিনীর সামরিকীকরণে। এর পর ওবামা প্রশাসন আসার পর উন্মুক্ত হয় প্যাট্রিয়ট আইনের অপপ্রয়োগ এবং এর মাধ্যমে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে নিজ দেশের মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসা প্রসারের অলিগার্কি রাজনীতি। ওবামা প্রশাসন প্যাট্রিয়ট আইনের অনেক ধারা সীমিত করে এবং সংবিধান এবং জনগণের অধিকার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। ওবামা প্রশাসন 1033 প্রোগ্রামও সীমিত করে কিন্তু আমেরিকার পুলিশ ফোর্স এতে অখুশি হয় এবং ট্রাস্প প্রশাসন পুলিশকে ক্ষমতায়িত করার পক্ষে কাজ করতে থাকে।
আমেরিকায় পুলিশ বাহিনীর সামরিকীকরণ ঘটলেও আমেরিকা ও দুনিয়ার দুর্বল প্রশাসনের অন্যান্য দেশ এক নয়। গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতায় আমেরিকা এখনও উচ্চ অবস্থানের দেশ যেগুলোর সহায়তা নাগরিকদের রক্ষা করে। দুর্বল গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সুযোগ, দুর্বল ও দুষ্প্রাপ্য আইনী সহযোগীতা, সনাতন ও দুর্বল বিচারিক কাঠামো, অধিকার ভিত্তিক রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গির অভাব, সর্বত্র দুর্নীতি এবং দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো যে সব দেশে বিরাজমান, সেই সব দেশে পুলিশ বাহিনীর সামরিকীকরণ রাষ্ট্রকে ফ্রাঙ্কেষ্টইনে পরিণত করে। এর ফলে ভীতির রাজ্য কায়েম হয় এবং যার অন্তিম পরিণতি হচ্ছে পুলিশ ও সামরিক বাহিনী ছাড়া রাষ্ট্রের আর সব প্রতিষ্ঠান দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে কারণ সরকারের জবাবদিহীতা লোপ পায় যে কোন গণতান্ত্রিক দেশে যেটি সকল উন্নয়নের রক্ষাকবজ।