EN
আরও পড়ুন
ধর্ম ও দর্শন
গ্লোবালিস্টদের উদ্যোগ ও সহায়তায়
গবেষণা
বহুকাল দারিদ্র ও অপুষ্টিতে ভোগা সমাজের হঠাৎ ধনী হয়ে যাওয়া
রাজনীতি
মিয়ানমার নিয়ে বিপজ্জনক খেলা
রাজনীতি
বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য দীর্ঘমেয়াদে গুরুতর হুমকি
রাজনীতি
JadeWits Technologies Limited

আন্তর্জাতিক নারী দিবস

নারী স্বাধীনতা: সাচ্চা বনাম ভুয়া

সকলের বন্ধু আমাদের খসরু ভাই। এর ভাল দিক হল খসরু ভাইয়ের সাথে পরিচয় না হলে অনেক অসাধারণ মানুষের সাথে আমার কখনও যোগাযোগ হত না। খসরু ভাইকে অনেকে বাঘ খসরু বলে কিন্তু আমার মনে হয় তাকে নেট খসরু বলাটা আরও যুক্তিযুক্ত হত কারন তিনি একজন নেটওয়ার্ক মাস্টার যার নেটওয়ার্কে সবাই।

যাই হোক একদিন দুপুরবেলা খসরু ভাই ফোন করে বললেন আজ রাতে আসব, আছেন নাকি? আমি বললাম আসেন। সন্ধায় বাসায় ফিরে দেখলাম রাতের খাবার কি আছে ফ্রিজে। যা আছে তাতে দুজনের হয়ে যাবে। সন্ধা সাতটার দিকে কলিং বেলের শব্দ শুনে দরোজা খুলে তো হতভম্ভ, খসরু ভাইই শুধু না, সাথে ড: আইনুন নিশাত ও আরও একজন। ড: আইনুন নিশাত বিখ্যাত ব্যক্তি, তিনি বাসায় এলে কিছু প্রস্তুতির প্রয়োজন নিশ্চই ছিল, যাইহোক, অফিস সহকারীকে চাইনিজ খাবার আনতে পাঠিয়ে সে যাত্রা রক্ষা।

আর একদিন খসরু ভাই ফোন করে বললেন আমরা যারা বাংলাদেশে প্রাণী প্রকৃতি নিয়ে লেখালেখি করি, ছবি তুলি তাদের সাথে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান সাহেব বসতে চান, বললেন কাল, বৃহষ্পতিবার দুপুরে, চলে আসবেন। বললাম কাল লাউয়াছড়া যাব, গাড়ীতে ব্যাগ ক্যামেরা নিয়েই আপনাদের অফিসে যাব, মিটিং শেষ করে রওয়ানা দেব। খসরু ভাই বললেন চলে আসেন। যথারীতি মিটিং শেষ হলে তিনি বললেন ও হ্যাঁ, আপনাকে তো বরা হয় নি, আপনি তো গাড়ি নিয়েই লাওয়াছড়া যাবেন, রেজা ভাইকে নিয়ে যান, আপনি যাবেন শুনে উনি ব্যাগ গুছিয়েই চলে এসছেন। রেজা খান ভাইও বিখ্যাত ব্যক্তি, দুবাই চিড়িয়াখানাটা অনেকটা তাঁরই, যদিও তখনও তাঁর সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় হয় নি। হঠাৎ একজন বিখ্যাত লোক এত দুরের পথে সাথী হবেন। একটু বিব্রতই হলাম। যাই হোক মিটিং শেষ করে আমরা রওয়ানা দিলাম।

রেজা ভাইয়ের সাথে টুকটাক কথা হচ্ছে, বুঝলাম তিনি অভিজ্ঞ মানুষ ও বন্ধুত্বপরায়ন, এতে আমার ড্রাইভিং এবং একাকী আগোছালো যাত্রা নিয়ে যে দ্বিধাটুকু ছিল সেটা দ্রুতই কেটে গেল। আমরা জ্যাম ঠেলে এগোচ্ছি যাব টঙ্গী, পুবাইল, ঘোঁড়াশাল, পাঁচদোনা হয়ে N2 ধরে শ্রীমঙ্গল। এয়ারপোর্টের ক্রসিংটার আগে তখন ডিভাইডারে একটা ছোট্ট কাটা ছিল সেখান দিয়ে গাড়িগুলো ইউটার্ন নিতে পারত। ট্রাফিক সিগনাল দিলে আমি চলতে শুরু করি কিন্তু কোন কারনে বামের বাসটা থেমে গেলে আমি ডানে নিয়ে আর একটা সিএনজির পিছন দিয়ে বেরিয়ে যেতে চাই। এমন সময় ট্রাফিক আবার থামিয়ে দেয়। এমন সময় ইউটার্ন নিতে চাওয়া আমার পিছনের একটা গাড়ি হর্ন বাজাতে থাকে পাগলের মত। সামনে ট্রাফিক আটকানো তবুও গাড়িটা হর্ন বাজাতে থাকে। আমি এবং রাস্তার সবাই বিরক্ত।

এর পর রিয়ার ভিউ মিররে দেখি বছর পয়ত্রিশের যথেষ্ট স্মার্ট ও আকর্ষনীয়া এক মহিলা ঐ গাড়ির ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে এলেন। পোশাকে আধুনিকা, ছেলেদের মত ছাঁটা চুল, পরনে প্যান্ট আর ফতুয়া টাইপের পোশাক। তেড়ে মেরে আমার গাড়ির জানালার কাছে এসে চরম হম্বিতম্বি। আমি ঢাকায় নতুন চালাই কিনা, আমাকে নেমে আসার আহ্বান যেন তিনি দেখে নেবেন ইত্যাদী। আমি একা থাকলে হয়ত আমিও দেখে নিতে চাইতাম। কিন্তু একজন সিনিয়ার বিশিষ্টজন যার সাথে নতুন পরিচয় তাই তাঁর দিকে চাইলাম। তিনি খুব বিরক্ত হয়ে বললেন বুঝেছি, বাংলিশ চরিত্র, আমার আগেই উনি যেন ধরে ফেললেন মহিলা কি করতে চাচ্ছেন এবং আমাকে বললেন আপনি কোন কথা বলবেন না। উনার যা খুশি উনাকে বলতে দিন। কোন কথা বলবেন না।

ভদ্রমহিলা যখন আমাকে বকাবকি করছেন তখনই ট্রাফিক সিগনাল ছেড়ে দিল। তিনি তখন রাস্তায় দাড়িয়ে এবং তার পিছনে যে গাড়িগুলো তারা তখন প্রচন্ড জোর হর্ণ বাজিয়ে চলেছে। এটি যখনকার ঘটনা তখন আমার ড্রাইভিং লাইসেন্সের বয়স এক যুগ হয়ে গেছে। আমি অবাক হলাম ঢাকার রাস্তায় অনেক ট্রাফিক বিশৃংখলা হয়ে থাকে। কখনও চালকেরা ভুল করে কখনও পুলিশ ভুল করে যার ফলে যাত্রায় বিঘ্ন ঘটে। কিন্তু কখনও আমি কোন পুরুষ চালককে দেখিনি দুর্ঘটনা না ঘটে থাকলে শুধুই সামান্য বিলম্বের জন্য গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে ঝগড়া করতে। বিষয়টা নিয়ে আমরা অনেকক্ষণ কথা বলি।

নারী স্বাধীনতা, আমরা যারা নারী পুরুষের সমতা সর্বক্ষেত্রে দেখতে চাই। মেয়েরা উচ্চশিক্ষিত হলে, চাকরি করলে, ইংরেজীতে কথা বললে, পশ্চিমা ড্রেস পরলে, ছেলেদের মত চুল কাটলে, মোটর সাইকেল বা গাড়ি চালালে আমাদের কখনও মনে হয় সমাজ সত্যিই এগোচ্ছে নারী স্বাধীনতা ও লিঙ্গ সমতার দিকে। কিন্তু তাদের আগ্রাসী অসহনশীল আচরণ, যত্রতত্র মরিয়া আত্মপ্রতিষ্ঠার আবেগ, অপরিচিতের সাথে আচরনে চরম ডিগনিটির অভাব, অতি স্বাথর্পরতা, আত্মকেন্দ্রীকতা – এই সব কিছুই এক ভীরু, আত্মমুল্যের অভাবে ভোগা, অপরিচিত সবাইকে সন্দেহ করা এক হীন মানসিকতার পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করে যেন। যেটি আসলে আত্ম পরাধীনতারই চরম প্রকাশ। যাই হোক, ক্রমেই আমরা ট্রাফিক জ্যাম ছাড়িয়ে গেলাম এবং পথের দু-ধারের প্রকৃতির সৌন্দর্য্য আমাদের মানুষের অপব্যবহারের গ্লানী থেকে দ্রুতই মুক্ত করে দিল।

শ্রীমঙ্গল থেকে ফিরে এসেই আবার আমি সুন্দরবনের পথে রওয়ানা দিলাম। এবার বিমানে যশোর গিয়ে গাড়িতে খুলনা। তারপর স্পিডবোটে সুন্দরবন। কাজ ছিল একটি ফরাসী টিভি ডকুমেন্টরি ফিল্মিং দলের জন্য রেকি করা। বনে ঢুকতেই যে প্রিয় গ্রামাটি সেখান থেকে শুরু। বাঘের খোঁজ করতেই লোকজন বলল “পাশের গ্রাম থেকে দুজনকে নিয়ে গিয়েছে গত মাসে। এই গ্রামেও একজনকে ধরেছিল কিন্তু মানুষ ছুটিয়ে নিয়ে এয়েছে। ওইযে বাড়িটা দেখা যায়, ওর দুটো বাড়ি পরেই পাবেন, সে বাড়িতেই আছে”।

খুঁজে পেতে লোকটাকে বের করলাম। ত্রিশের কোঠায় বয়স। বাঘের কামড়ে মুখটা বেঁকে গেছে। আমাকে বাসায় নিয়ে ঘরের থেকে চেয়ার এনে বসাল। বলল “একটা ডাব পেড়ে দি, কত দুর থেকে এয়েছেন”। এই বলে পাশের বাড়ির একজনকে হাঁক দিল। আমি বললাম ওসব পরে হবে, এখন বসেন, কথা বলি। কিভাবে হল ঘটনা, বলেন দেখি।

লোকটা বলতে শুরু করল সে চরপাটা জাল দিয়ে এসেছিল রাতে। সকালে সে আর তার পাশের বাড়ির এক পাতানো বোন সেটা তুলতে গিয়েছিল। মেয়েটা নৌকায় ছিল আর সে ছিল পাড়ে হাঁটু কাদার মধ্যে জাল তুলছিল সাথে গুছিয়ে নিচ্ছিল সরু খুঁটিগুলো পাড় থেকে তুলে। গুঁড়ি হয়ে মাছ তুলতে গিয়েই দেখে সামনে তিন হাত দুরে উঁচু ডাঙ্গায় বসে ওঁত পাতা বাঘ। সারাদিন মাছ ধরলেও গ্রামে আধ্যাত্মিক লোক সে, মানুষের পুজা অর্চণা করে দেয়। সামনে স্বয়ং ভগবান। ভয় না পেয়ে হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা শুরু করে সে। কিন্তু ক্ষুধার্ত বাঘের তখন ধর্মকর্মের সময় নেই। এক লাফে কামড়ে ধরে চোয়াল সহ মাথা।

কাদার মধ্য দিয়ে বাঘটা টেনে নিয়ে যেতে থাকে মানুষটিকে। নৌকায় থাকা মেয়েটি তার বয়সিই। কিন্তু ঘটনার আকষ্মিকতায় খেই হারায় না সে। চিৎকার করে একটু দুরেই থাকা আর একটি নৌকাকে ডাকতে থাকে সে। যেখানে তারই ভাসুর আর ভাবী একই কাজ করছিল। কাছে এসে বাঘটি জ্যান্ত লোকটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দেখে তার ভাসুর পুরুষটি ভয়ে স্থবির হয়ে যায়। কিন্তু নারী দুজনের কেউই সম্বিত হারায় না। মেয়েটি বলতে থাকে মরুক বাঁচুক আমার ভাইটিকে নিয়ে যেতে দেব না। এই বলে বৈঠা দিয়ে বাঘটিকে পিটাতে শুরু করে সে। সাথে যোগ দেয় তার ভাবী। দুই নারীর হার না মানা বিরত্বে ক্ষান্ত দেয় বাঘ। লোকটাকে ছেড়ে বনের ভিতরে পালায় সে।

বাকিটুকু শোনার জন্য ঐ দুই মহীয়ষী নারীকে খুঁজে বের করি আমি। তারা একজন বাড়িতে থাকলেও আর একজন বনে গেছে জাল পাততে। সন্ধায় দেখা পাই তাদের। তারা বলতে থাকে ঘটনার বাকী অংশ “যত শক্তিই থাক না বাঘের গায়, ভাইকে নি যেতে দেব না। বাঘ পালিই গেল যখন তখন কি করি। এক মানুষ নৌকায় অজ্ঞান, আর একজন কাদার মধ্যে পড়ে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে, পানি লাল হয়ে গিয়েছে নদের। আমরা চিৎকার কচ্চি বাঁচাও বাঁচাও। গাঁও কাচেই, আপনি তো দেকিচেনই জঙ্গলে কুতায় ধরেচিল বাঘে। নাওটাও ভাটায় পানি নেবে কাদায় আটকি রয়েছে তখন। কি যে কষ্টে টেনে ওরে কোনমতে নৌকায় উটিয়ে আমরা দুজনাতে ঠেলে নাউ ভাষাই। তারপর গাঁওয়ের লোকজনে এসে হাসপাতলে নেয় ওকে”।

আমি অবাক হয়ে শুনি দুই নারীর বিরত্বের কাহিনী। মেয়েটি মানুষখেকো বাঘের সাথে যুদ্ধের সাহস পেয়েছিল কি পাতানো ভাইয়ের প্রতি ভালবাসার জোরেই? বারবারই দুজনে বলছিল, "ও এত ভাল মানুষ, ওকে আমরা রেখে আসতে পারি নে"। সব সাহসের গোঁড়ায় যেন অন্যের জন্য অনুভুতি বা এমপ্যাথি নিয়ামক।

আমি ভাবতে থাকি এই একযুগ আগেই এই বনে নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। বাঘের এই আক্রমনে যে আক্রান্ত সে নিজেই একজন পুরোহিত, যে পুজো করে বেড়ায়। যে পুজারকেরা নারীকে বনে নিষিদ্ধ করেছিল সেই পুজারকেরই জীবন বাঁচাল নারী। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম আগে তো মেয়ে মানুষের বনে যাওয়া বারন ছিল, এখন আপনাকে তারাই বাঁচাল, এটিকে আপনি কিভাবে দেখেন? তার জবাব শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। সে বলল এই যে আপনি আমার ঘরের উঠোনে বসে কথা বলছেন, বাড়ীর মেয়েরা এসে আপনার সাথে কথা বলছে, এটা কি আগে পারতেন? অর্থাৎ সে যেন বলতে চাইল জীবনের প্রয়োজনে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।

আমার মনে ভেসে উঠল নৃবিজ্ঞানী এডোয়ার্ড টি হলের বইতে লেখা পাতাগুলো। কোন সমাজ বা সংস্কৃতি প্রগ্রসর হয় বা স্বাধীন হয় তখনই যখন ঐ সংস্কৃতি মেনে যারা চলে যখন তারা নিজেদের জীবনযাত্রাকে সীমিত পরিবর্তীত করে সময়োপযোগী করে। তখনই মানুষের পরাধীনতা থেকে প্রকৃত মুক্তি ঘটে। কিন্তু নিজের সংস্কৃতিকে যারা সনাতন ভেবে ত্যাজ্য করে। বা সেটাকে কখনও গ্রহণই করেনা, তারা শুধু মুক্তি বা অগ্রসরতার পোশাকি অনুকরণই করতে পারে যেটা সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্তদের বিভ্রান্তই করে মাত্র। আমার মনে পড়ে গেল সেই আধুনিকা মহিলার কথা যিনি গাড়ি থেকে নেমে ঝগড়া করতে উদ্যত ছিলেন একহাত দেখিয়ে দিতে।

নারীমুক্তি বা স্বাধীনতা তাই শহরে মেকি জীবনে বিদেশি ক্ষমতাশীল সংস্কৃতির অনুকরণে ঘটে না, ঘটে না নারীত্বকে বিসজর্ন দিয়ে পুরুষ জীবনাচরণকে অনুকরণ করে। ঘটে সংস্কৃতিতে যেমন করে ঘটে তেমন করেই। নারী হিসাবে নিজেকে ভালবেসে, নিজের নারী প্রকৃতি তথা নারীত্বকে গ্রহণ করে আধুনিকতার সাথে জীবনযাপনের সংঘর্ষকে মানিয়ে নিতে নিজের সংস্কারকে নতুন করে গড়ে যারা, তাদের মাধমেই। নারী স্বাধীনতা তাই শহুরে পোশাকী আধুনিকতায় পুরুষকে অনুকরণে নয়, শ্বাশ্বত নারী জীবনকেই নতুন করে লিখছে যারা জীবনের প্রয়োজনে, ঐ বাঘের সাথে যুদ্ধ করে ভাইকে ছিনিয়ে আনা গ্রামীন নারীদের মাধ্যমেই ঘটে চলেছে সবার অগোচরে। বাকী সব মেকি, নকল, ভুয়া স্বাধীনতা। হারিয়ে যাবে কালের অতল অন্ধকারে।

JadeWits Technologies Limited
সর্বশেষপঠিতনির্বাচিত

আমরা আমাদের সেবা উন্নত করতে কুকি ব্যবহার করি। আমাদের কুকি নীতির শর্তাবলী জানার জন্য অনুগ্রহ করে এখানে ক্লিক করুন। কুকি ব্যবহারের জন্য আপনি সম্মত হলে, 'সম্মতি দিন' বাটনে ক্লিক করুন।