২৩০০ বছর আগে চাণক্য কৌটিল্য বলে গেছেন "অবহেলায় কর্মনাশ হয়, যথেচ্ছ ভোজনে কুলনাশ হয়, যাচ্ঞায় সম্মান-নাশ হয়, দারিদ্র্যে বুদ্ধিনাশ হয়"। তিনি আরো বলে গেছেন "দুর্বলের বল রাজা, শিশুর বল কান্না, মূর্খের বল নীরবতা, চোরের মিথ্যাই বল"। ২৩০০ বছর পরে আজ আমাদের সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখুন দেখতে পাবেন একটি জাতী যাদের সকল কিছুতে অবহেলা, যাদের জীবনের লক্ষ্য ভোজন, যাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে যাচনা বা প্রার্থনা করা এবং যারা বুদ্ধিহীন। এখনও এই সমাজের বেশিরভাগ মানুষ রাজাদের বা প্রধানমন্ত্রীদের এক নম্বর ভক্ত তারা যত মন্দই হোন না কেন, তারা স্বল্পতেই কান্না বা আবেগ প্রদর্শন করে, শত অন্যায়েও তারা নীরব থাকে এবং তারা প্রার্থনাতেও মিথ্যা বলে। যার অর্থ হলো এমন এক জাতী যারা বলে দুর্বল, মনে শিশু, জ্ঞানে মূর্খ এবং চরিত্রে চোর। কেন ক্রমেই এমন হয়ে যাচ্ছি আমরা?
কোরান বাইবেল ও তাওরাত তিনটিই আসমানী গ্রন্থ যেটা আল্লাহ প্রেরিত। এইসব আসমানী গ্রন্থে সন্তান যাতে ইবলিশে বা সোশিওপ্যাথে পরিণত না হয় তার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আছে যেটা অনেকেই ধরতে পারেন না। বেশ বয়স হয়ে গেলেও তিন বৃহৎ ধর্মের সূচনাকীরা নবী ইব্রাহীমের কোন সন্তান হচ্ছিল না। তিনি চিন্তিত। সন্তান না থাকলে তাঁর যে নবুয়ত সেটা সামনে নিয়ে যাবে কে? মধ্যপ্রাচ্যে জন্ম নেওয়া এক আল্লাহর প্রথম নবী তিনি যার মাধ্যমে তিনটি মহান জাতি এক আল্লাহর পথে আসবে, সেই প্রতিজ্ঞার কি হবে? সন্তানহীন বিবি সারাহরও দু:খের সীমা নাই। যে কোন নারীর মত তিনিও পরিবারে সন্তান চান। সারাহ স্বামীকে বললেন আমার না হোক অন্য কারোর গর্ভে হলেও তার সন্তান চাই। সারার দাসী হলেন হ্যাজার যিনি ছিলেন মিশরের নারী যাকে দাসী হিসাবে উপহার প্রদান করা হয়েছে ইব্রাহীম পরিবারের জন্য। হিব্রুতে হ্যাগার বা আরবিতে হ্যাজার শব্দের অর্থ হল বিদেশী বা অভিবাসী। নিজ দাসী হ্যাজারের গর্ভে একটি সন্তান এনে দিতে অনুরোধ করলেন তিনি।
এভাবেই দাসী হ্যাজারের গর্ভে এল পুত্র ইসমাইল। এর কিছুদিন পরেই বিবি সারাহর গর্ভেও একটি সন্তান এল। ভূমিষ্ঠ হলে যার নাম রাখা হল ইসহাক। আস্তে আস্তে বেড়ে উঠল দুই ভাই ইসমাইল ও ইসহাক। একদিন কিশোর ইসমাইল অন্যায়ভাবে ত্যক্ত করছিল ইসহাককে। বিষয়টা সারাহ জানালেন হ্যাজারকে যেন তিনি নিজ সন্তানকে শাসন করেন। কিন্ত উল্টো অন্যায়কারী ছেলের পক্ষ নিয়ে রগচটা বদমেজাজী আচরণ করলেন হ্যাজার।
সেটিতে মনে খুব কষ্ট পেলেন সারাহ। ইসমাইল ও ইসহাক দুজনকেই তিনি নিজ সন্তানের মত দেখেন। তিনি চান উভয়েরই ভাল আচরণ, তাদের কেউ অন্যায় করলে সেটার সুবিচার ও শাসন। অথচ হ্যাজার সেই সুবিচারটাই করতে পারলেন না। এর ফল হল অন্যায্য ও অন্যায় পরিবেশে দুটি শিশুরই বেড়ে ওঠা যার ফল কখনই ভাল নয়। অপরাগ হয়ে তিনি জানালেন স্বামী ইব্রাহীমকে। বললেন বিষয়টির সমাধান করতে করতে।
ঘটনাটি শুনে পুত্রদের বাবা ইব্রাহীমও খুব মন:ক্ষুন্ন হলেন। তিনি কোন সমাধান খুঁজে পেলেন না। তিনি দেখলেন অভিভাবক নিজে যদি সন্তানের ন্যায় অন্যায় না বুঝে এবং শিশুদের সামনে ন্যায্য ও আদর্শ মানসিকতার উদাহরণ না রাখে, তাহলে সেই শিশুরা মন্দ আচরণের অধিকারী ও ক্ষমতার অপপ্রয়োগকারী হতে বাধ্য। তিনি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানালেন, জানতে চাইলেন কি করবেন তিনি। তিনি কোন সমাধান খুঁজে পাচ্ছেন না। হ্যাজারের আচরণ পুরো পরিবারের ন্যায্য পরিবেশটাকে কলুষিত করে ফেলবে। এটা চলতে থাকলে শুধু ইসমাইল সয়, ইসহাকের ভবিষ্যতও অন্ধকার। সন্তানেরা মন্দ উদাহরণ শেখে। অনৈতিক গৃহ পরিবেশে বেড়ে ওঠা কোন শিশুই নৈতিক ও আদর্শ মানুষ হতে পারে না।
আল্লাহ নির্দেশ দিলেন সন্তান সহ হ্যাজারকে গৃহ থেকে বিতাড়িত করে দিতে। যে মাতা সন্তানের অপকর্মে অন্ধ থেকে তার পক্ষ নেয়, তার সংস্পর্শে অন্য সন্তানেরা ভাল থাকতে পারে না। ইহুদী, খৃষ্ট আর ইসলাম এই তিন ধর্মের আল্লাহ এক। এই তিন ধর্মেরই নবী ইব্রাহীম। তিনি নিজেই এই কঠিন কাজটি করেছেন। তার নির্দেশে সন্তানের অন্যায়ের প্রতি অন্ধ ক্ষুব্ধ হ্যাজার নিরুদ্দেশ হয়েছেন ধু ধু মরুভূমীতে।
কিন্তু ভাল ছেলে ইসহাকের কি হল? এত ভাল ছেলে ইসহাক, সৎ চরিত্র, আদব কায়দা, কর্মে চিন্তায় ত্রুটিহীন। ফলে সে হয়ে গেল বাবা মায়ের চোখের মণি। বাবা মা দুজনের ভালবাসায় সে সিক্ত। মহান নবী ইব্রাহীমের বংশ সামনে নিয়ে যাবে সে। কিন্তু বাবা মা দুজনের এত ভালবাসা আর আগ্রহ কি সুপথে রাখবে ইসহাককে? রাখবে না। তাই আল্লাহ স্বপ্ন দেখালেন ইব্রাহীমকে, যে তাকে তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিষটিকে কোরবানী দিতে হবে। সেই প্রিয় জিনিষ কি? তার পুত্র ইসহাক। নবী ইব্রাহীম তাই পরদিনই ইসহাককে নিয়ে হাঁটা ধরলেন পাহাড়ের চুড়ায় যে বেদীতে কোন কিছু উৎসর্গ করার রেওয়াজ সেখানে। ছেলে ইসহাক বয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোরবানীর সরঞ্জাম। যেতে যেতে প্রশ্ন করছে বাবা কোরবানীর যাকে দেওয়া হবে সেই মেষটা কই? বাবা বললেন আল্লাহ ভরসা। পাহাড়ের উপরে নিয়ে গিয়ে দুজনে মিলে সব আয়োজন করে ইব্রাহীম ছেলেকে বললেন কোরবানীর সময় মেষটা যেভাবে নত হয় সেভাবে তুমি নত হও। তার পর তাকে চোখ বন্ধ করতে বলে চালিয়ে দিলেন দিলেন ছুরি।
এই পর্বের শিক্ষা কি? সন্তান আদর্শ ও প্রিয় হলেও তার চেয়ে নীতি, আদর্শ ও সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ বড়। সন্তান যাতে অ্যানার্কিক সোশিওপ্যাথ না হয়ে যায় তার জন্য চার হাজার বছর ধরে বয়ে আসা দুটো শিক্ষা হল সন্তানের অন্যায়ের প্রতি অন্ধ যে তাকে ত্যাজ্য করতে হবে, আর বাবা মায়ের চোখের মণি সুপুত্রের চেয়েও নৈতিকতা ও সামগ্রিকতা বড়। সঠিক প্যারেন্টিং এর এই দুটো শিক্ষা বুঝতেই আমরা ব্যর্থ হয়েছি। তাই তৈরি হয়েছে অসভ্য বর্বর এক প্রজন্ম যারা শয়তানের প্ররোচনায় একটি অসম যুদ্ধের সামনে দাড় করিয়ে দিয়েছে জাতীকে।