EN
আরও পড়ুন
রাজনীতি
পলিটিক্যাল সিস্টেমস থিংকিং এর শিক্ষা
রাজনীতি
JadeWits Technologies Limited
ধর্ম ও দর্শন

ধর্মের সিস্টেমস থিংকিং -৩

খ্রীস্টিয় আইন ও ইসলামি ব্যাখ্যা

আগের পর্ব: ধর্মের সিস্টেমস থিংকিং -২

নিজের পর্যবেক্ষণ থেকেই ধারণা করেছিলাম যে আমাদের দেশে হাদিস বলে যেগুলো প্রচার হয় সেগুলোর বেশিরভাগই আসলে ইহুদি খ্রীষ্টান আইনের ব্যখ্যা বা জুরিসপ্রুডেন্স নির্ভর। উদাহরণ হিসাবে যেমন: কোরআনে স্পষ্ট করা আছে যে জেনাহ বা অবৈধ যৌনতার শাস্তি:

“আর নারীদের মধ্যে যারা ব্যভিচারিণী তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের মধ্য থেকে চার জন পুরুষকে সাক্ষী হিসেবে তলব কর। অতঃপর যদি তারা সাক্ষ্য প্রদান করে তবে সংশ্লিষ্টদেরকে গৃহে আবদ্ধ করে রাখ, যে পর্যন্ত মৃত্যু তাদেরকে তুলে না নেয় অথবা আল্লাহ তাদের জন্য অন্য কোন পথ নির্দেশ না করেন। তোমাদের মধ্যে যে দুজন সেই কুকর্মে (ব্যভিচারে) লিপ্ত হয়, তাদেরকে শাস্তি প্রদান কর, অতঃপর তারা যদি উভয়ে তওবা (অনুশোচনা,অনুতাপ) করে এবং নিজেদের সংশোধন করে, তবে তাদের থেকে হাত গুটিয়ে নাও। নিশ্চই আল্লাহ তওবা কবুলকারী, দয়ালু। ”

— সূরা: নিসা, আয়াত: ১৫-১৬

"ব্যভিচারের দায়ে অভিযুক্ত পুরুষ ও নারী যারা,- তাদের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত প্রদান কর: তাদের বিষয়ে করুণা যেন তোমাদেরকে দুর্বল না করে, এমন একটি বিষয়ে যা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত হয়েছে, যদি তোমরা আল্লাহ এবং মহাপ্রলয় দিবসের উপর বিশ্বাস রাখো: এবং বিশ্বাসীদের একদলকে তাদের শাস্তির সাক্ষী করে রাখো।"

— কুরআন, সূরা ২৪ (আন-নুর), আয়াত ২

অথচ হাদিসে শাস্তি:

হাদিসে যিনার শাস্তির বর্ণনা এসেছে জনসম্মুখে বেত্রাঘাত এবং পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড হিসেবে, এটি পাওয়া যায় মূলত হাদিসের "কিতাব-আল হুদুদ" নামক সংকলিত খণ্ডাংশে।

'উবাদা বিন আস-সামিত বর্ণনা করেন: আমি আল্লাহর রাসুলকে বলতে শুনেছি: আমার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ কর। আল্লাহ সেসব মহিলাদের জন্য আদেশ জারি করেছেন। যখন একজন অবিবাহিত পুরুষ একজন অবিবাহিত নারীর সাথে ব্যভিচার করে, তাদেরকে একশত বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য নির্বাসন পেতে হবে। আর বিবাহিত পুরুষের সাথে বিবাহিত নারীর ব্যভিচারের ক্ষেত্রে, তাদেরকে একশত বেত্রাঘাত এবং পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে হবে।

— সহীহ মুসলিম, ১৭:৪১৯১

আল্লাহর রাসুল বিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীকে পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি প্রদান করতেন এবং, তাঁর পরে, আমরাও পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি প্রদান করতাম, আমি ভয় করি যে কালের অতিক্রমের সাথে সাথে, মানুষ হয়তবা এটি ভুলে যাবে এবং হয়তো বলবে: আমরা আল্লাহর কিতাবে পাথর নিক্ষেপের শাস্তি খুঁজে পাই নি, এবং আল্লাহর নির্দেশিত এই কর্তব্য পরিত্যাগ করে বিপথে যাবে। পাথর নিক্ষেপ হল আল্লাহর কিতাবে দেয়া ব্যভিচারী বিবাহিত পুরুষ ও নারীদের জন্য ধার্যকৃত একটি দায়িত্ব যখন তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়, অথবা যদি গর্ভধারণ ঘটে, অথবা যদি দোষ স্বীকার করা হয়।

— সহীহ মুসলিম, ১৭:৪১৯৪

মা'য়িয মুহাম্মদের নিকট এলো এবং তার উপস্থিতিতে নিজের ব্যভিচার করার কথা চারবার স্বীকার করল, তাই মুহাম্মদ (সাঃ) তাকে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করার আদেশ দিলেন। কিন্তু হুজ্জালকে বললেন: "তুমি যদি তাকে তোমার কাপড় দ্বারা ঢেকে দিতে, তাহলে তা তোমার জন্য ভাল হত।"

— সুনান আবু দাউদ, ৩৮:৪৩৬৪

আরেক বিশুদ্ধ নির্ভরযোগ্য হাদিস গ্রন্থ সহিহ বুখারীতে কয়েকটি ঘটনা পাওয়া যায় যেখানে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যার কথা উল্লেখ রয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ,

আয়েশা কর্তৃক বর্ণিত: 'আব্দ বিন জা'মা বলল, "এই বালক আমার ভাই এবং আমার পিতার দাসীর ছেলে, এবং আমার পিতার বিছানায় তাঁর জন্ম হয়েছিল।" আল্লাহর রাসুল বললেন, "এই বালকটি তোমার, হে 'আব্দ বিন জা'মা!" এরপর আল্লাহর রাসুল আরও বললেন, "উক্ত সন্তানটি বিছানার মালিকের, এবং উক্ত ব্যভিচারকারীকে পাথর নিক্ষেপ করা হোক।"

— সহীহ বুখারী, ৯:৮৯:২৯৩

ইহুদি খ্রিস্টান আদি পুস্তকে (ওল্ড টেস্টামেন্টে) আছে জেনাহ করার জন্য পাথর ছুঁড়ে হত্যার কথা:

“একজন পুরুষ কোন স্ত্রীলোককে বিবাহ করে তার সাথে য়ৌন সম্পর্ক স্থাপন করার পরে মনস্থ করতে পারে সে তাকে আর চায না। সেই জন্য সে মিথ্যাভাবে বলতে পারে, ‘আমি এই স্ত্রীলোকটিকে বিবাহ করেছিলাম বটে কিন্তু য়ৌন সহবাসের সময় দেখলাম য়ে সে কুমারী নয়|’ এই বলে সে সেই স্ত্রীলোকটির উপর দুর্নাম আনতে পারে। এই রকম ঘটলে মেয়েটির পিতা-মাতা সেই মেয়েটির কুমারীত্বের প্রমাণ নিয়ে নগরের প্রবীণদের সাথে নগরের সভাস্থলে উপস্থিত হবে। মেয়েটির পিতা প্রবীণদের বলবেন, ‘আমি আমার মেয়েকে এই লোকটির হাতে তার স্ত্রী হিসাবে দিয়েছিলাম কিন্তু এখন সে তাকে পছন্দ করে না। এই লোকটি আমার মেয়ের নামে মিথ্যা বলেছে। সে বলেছে, “তোমার মেয়ে কুমারী ছিল না|” কিন্তু এই দেখুন আমার মেয়ে য়ে কুমারী তার প্রমাণ|” এই বলে তারা কাপড়টি নগরের প্রবীণদের দেখাবে। তখন সেই নগরের প্রবীণরা অবশ্যই সেই লোকটিকে নিয়ে গিয়ে শাস্তি দেবে। তারা অবশ্যই লোকটির জন্য ৪০ আউন্স রৌপ্য় জরিমানা করবে। সেই টাকা য়েন মেয়েটির পিতাকে দেওয়া হয়, কারণ মেয়েটির স্বামী একজন ইস্রায়েলীয় কুমারীর উপর দুর্নাম এনেছে। আর সেই মেয়েটি সেই লোকটির স্ত্রী হয়েই থাকবে। সেই লোকটি তার জীবনকালে তাকে বিবাহ বিচ্ছেদ দিতে পারবে না। কিন্তু এও হতে পারে য়ে মেয়েটির স্বামী তার সম্বন্ধে যা বলেছে তা সত্য। স্ত্রীলোকটির মাতা-পিতার কাছে তার কুমারীত্বের প্রমাণ নাও থাকতে পারে। যদি তাই ঘটে তবে নগরের প্রবীণরা সেই মেয়েটিকে নিয়ে তার পিতার বাড়ীর দরজায় আসবে। তারপর সেই নগরের লোকরা মেয়েটিকে পাথর মেরে হত্যা করবে। কারণ ইস্রায়েলের মধ্যে সে লজ্জাজনক কাজ করেছে। সে পিতার বাড়ীতে বেশ্যার মতো ব্যবহার করেছে। তুমি তোমার লোকদের মধ্যে থেকে এইভাবে দুষ্টাচার দূর করবে।” (ডিউটেরনমি ২১: ১৩-২১)

“যদি কোন পুরুষ অপরের স্ত্রীর সাথে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত থাকাকালীন ধরা পড়ে তবে দুজনকেই অবশ্যই মরতে হবে। সেই স্ত্রীলোকটিকে এবং তার সঙ্গে য়ৌন সম্পর্কে লিপ্ত পুরুষটিকে হত্যা করে তোমরা অবশ্যই ইস্রায়েলের মধ্যে থেকে এই দুষ্টাচার দূর করবে।” (ডিউটেরনমি ২১: ২২)

“কোন লোক অপরের বাগদত্তা কোন কুমারীকে নগরের মধ্যে দেখতে পেয়ে তার সাথে যৌন সহবাসে লিপ্ত হতে পারে। এই রকম ঘটলে তুমি অবশ্যই তাদের দুজনকে নগরের দ্বারে সকলের সামনে নিয়ে এসে পাথর মেরে হত্যা করবে। লোকটিকে হত্যা করার কারণ সে অপরের স্ত্রীর সাথে য়ৌন পাপ করেছে; এবং মেয়েটিকে হত্যা করার কারণ সে নগরের মধ্যে থাকলেও সাহায্যের জন্য চিত্কার করে নি।” (ডিউটেরনমি ২১: ২৩-২৪)

ধর্ষণকারীর সাথে বিবাহের বিষয়টিও ইহুদি খ্রিস্টান আদি পুস্তকে আছে:

“একজন লোক হয়তো বাগ্দত্তা নয় এমন কোন কুমারীকে পেয়ে তার সাথে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হতে পারে। যদি অন্য লোকরা তা ঘটতে দেখে, তাহলে সে মেয়েটির পিতাকে ২০ আউন্স রূপো দেবে এবং সেই মেয়েটি লোকটির স্ত্রী হবে। যেহেতু সে যৌন পাপ করেছিল, তাই তার জীবনকালে সে তাকে ত্যাগ করতে পারবে না।” (ডিউটেরনমি ২১: ২৮-২৯)

এগুলো দেখে খুবই আশ্চর্য লাগতে পারে যে জেনাহ করার জন্য কোরআনে যে শাস্তির কথা বলা আছে তার চেয়ে ২০০ বছর পরে ২০০০ কিলোমিটার দুরে যে হাদিসগুলো সংকলিত হয়েছিল সেখানে আরো কঠোর ও নৃশংস শাস্তুি কেন যা কোরআনের সাথে সাংঘর্ষিক। আরো আশ্চর্য যে আমাদের দেশে ফতোয়া দেবার সময় সেই হাদিসগুলো থেকেই ফতোয়া দেওয়া হয় যেগুলো পরিষ্কারভাবে কোরআন নয়, ইহুদি খ্রীষ্টান বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে নেওয়া। পাকিস্তান আফগানিস্তান সহ যে সব দেশে শরীয়া আইন চালু হয়েছে সেগুলোও কোরআন নয়, বেশিরভাগই যেন ইহুদি খ্রীষ্টান বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে নির্ভর।

এই প্যারাডক্সের কারণ বুঝতে গেলে দুটো বিষয় আমলে নিতে হবে। এক কারআন নাজেলের সময়ে এবং তার আগে পরে মক্কা এবং তার আশে পাশের ধর্মীয় ও সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি। তখন ছিল নগর রাজ্য বা সিটি স্টেটেরসময়। মক্কা শহর ওই সময় একটি বহু ধর্মের ধর্ম নিরপেক্ষ এলাকা ছিল। মানুষ ছিল খুবই মুক্তমনা ও স্বাধীন। বিশেষ করে নারী স্বাধীনতা ছিল অবিশ্বাস্য। অনেকে না জেনে নবী মুহম্মদকে বহু বিবাহ করেছিলেন বলে দোষ দেয়। কিন্তু তখন নারীরাও সেখানে অনেক বিবাহ করত। নবী মুহম্মদের প্রথম স্ত্রী খাদিজা সর্বমোট চারবার (ভিন্নমতে তিনবার) বিবাহ করেছিলেন। বিবি খাদিজা নিজ প্রচেষ্টায় সফল একজন ধনাঢ্য ও ব্যবসায়ী ছিলেন। নবী মুহম্মদকে বিবাহের প্রস্তাব তিনি নিজেই পাঠিয়েছিলেন। ঐতিহাসিকরা বলে থাকেন ঐ সময়ের আরবের সংস্কৃতি নারী ও মাতৃনিয়ন্ত্রিত ছিল। যৌনতা অনেকটাই মুক্ত ছিল এবং নারীরা যৌন বিষয়ে স্বাধীন ছিল। তারা প্রায়ই নিজ ইচ্ছায় এক স্বামী পরিত্যাগ করে অপরকে পছন্দ করতেন। এই রকম একটি মুক্ত সমাজে কঠোর সামাজিক আইন প্রণয়ণ সম্ভব হবার কথা নয়।

অপর দিকে এর ২০০ বছর পরে মক্কা থেকে দুই থেকে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার দুরে ইরান, উজবেকস্থান, তুর্কেমনিস্তান, আফগানিস্তানে যে ইসলাম অনুপ্রবেশ করেছে; এবং সেখানে কিতাবুস সিত্তাহ যে ছয়টি হাদিস গ্রন্থ সংকলিত হয়েছে, সেই স্থানগুলোর সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইসলাম আসার আগে সেগুলো ছিল পূর্বাঞ্চলীয় রোমান সাম্রাজ্যর অধীনে অথবা প্রভাবে। খ্রীস্টধর্ম মধ্যপ্রাচ্য থেকে তখন রোমে গিয়ে রাষ্ট্রধর্ম হয়ে আইন আকারে আবার মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়াতে ফিরে এসেছে মিশর, ইসরায়েল, তুরস্ক, সিরিয়া, লেবানন এলাকায়। খ্রীষ্টিয় শিক্ষা রোমের আইনি ছকে পড়ে পুনরায় আমদানী হয়েছে আল্লাহর আইন হিসাবে। পরে এইসব এলাকা মুসলিম শাসনের অধীনে গেলে আইন একই থেকে গেছে যেহেতু ইহুদি খ্রীষ্টান ও মুসলিমদের আল্লাহ এক। এই আইনগুলোর জুরিসপ্রুডেন্স বা আইনি ব্যখ্যাই হল হাদিসগুলো। এই বিষয়ে আরব ও মধ্য এশিয়ার ইতিহাস একটি পরিষ্কার ধারণা দেবে। যারা জানতে চায় তাদের জন্য পথ খোলা। একটি বইয়ের ছবি ও সূচি এখানে দিলাম।

পরের পর্ব: ধর্মের সিস্টেমস থিংকিং -৪

 

JadeWits Technologies Limited
সর্বশেষপঠিতনির্বাচিত

আমরা আমাদের সেবা উন্নত করতে কুকি ব্যবহার করি। আমাদের কুকি নীতির শর্তাবলী জানার জন্য অনুগ্রহ করে এখানে ক্লিক করুন। কুকি ব্যবহারের জন্য আপনি সম্মত হলে, 'সম্মতি দিন' বাটনে ক্লিক করুন।